একদিন আগেই গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান পল্টনের দাবা ফেডারেশন কার্যালয়ে এসেছিলেন খেলায় অংশ নিতে। ২৪ ঘণ্টাও পেরোয়নি, গতকাল শনিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে সেই জিয়া এলেন নিথর, প্রাণহীন হয়ে। সাদা কাফনে আবৃত জিয়াকে নামানো হলো লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি থেকে। দাবা ও ক্রীড়াঙ্গনের মানুষরা জানালেন শেষ শ্রদ্ধা। জানাজা ও বিদায়ী আনুষ্ঠানিকতা সারতে মিনিট চল্লিশেক সময় লাগল। এরপর জিয়াকে নিয়ে ফের ছুটে চলল লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি। চিরদিনের মতো দাবার প্রাঙ্গণ ছেড়ে চলে গেলেন এক কিংবদন্তি। বাংলাদেশ দাবায় অসীম শূন্যতা তৈরি করে চির আড়াল হলেন তিনি।
পরশু শুক্রবার ৪৮তম জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের ১২তম রাউন্ডে আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের সঙ্গে খেলা ছিল জিয়ার। সন্ধ্যার দিকে খেলতে খেলতেই চেয়ার থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নেওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। কিন্তু জাতীয় দাবার রেকর্ড ১৪ বারের চ্যাম্পিয়নকে আর ফেরানো যায়নি।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরান ভবনে দাবা ফেডারেশনের কার্যালয়। সেখানেই অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ৪৮তম জাতীয় দাবা। জিয়া খেলতে খেলতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে মিনিট দশেক সময়ের মধ্যে তাকে শাহবাগের ইব্রাহিম কার্ডিয়া হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা তার পালস পাননি। দাবাসংশ্লিষ্টদের ধারণা, জিয়ার মৃত্যু হয়েছে দাবার হলরুমেই। যেখানে চলছিল জিয়া-রাজীবসহ বিভিন্ন প্রতিযোগীর খেলা। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দাবার চৌষট্টি খোপে ঘুঁটির চাল নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন জিয়া। আদতে যার জীবনটাই ছিল দাবাময়।
২০০২ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় দাবাড়ু হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব জিতেন জিয়া। এরপর আরও তিনজন মিলিয়ে বাংলাদেশে গ্র্যান্ডমাস্টারের সংখ্যাটা মাত্র ৫। গত ১৬ বছর ধরে সংখ্যাটা এই পাঁচে আটকে আছে। একই রকমভাবে ঠিক একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে আছে বাংলাদেশের সামগ্রিক দাবাও। কেন এই জায়গা থেকে দাবা আর এগোতে পারছে না, এই হাহাকারের মাঝেই সবাইকে কাঁদিয়ে জিয়ার চির প্রস্থান। জাতীয় দাবায় সর্বোচ্চবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি যিনি দাবা অলিম্পিয়াডেও বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন সবচেয়ে বেশিবার।
সাদাসিধে একজন মানুষ ছিলেন জিয়া। কোনো অহম ছিল না। সব সময় ভেবেছেন কীভাবে দেশের দাবাকে এগিয়ে নেওয়া যায়। দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীম জানাজায় এসে বলেন, ‘দাবা পরিবারের জন্যই একটা অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। একজন গ্র্যান্ডমাস্টার কমে যাওয়ায় আমাদের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করতেও এখন অনেক বেগ পেতে হবে। তার অভাব পূরণ হওয়ার নয়।’ জিয়ার অবদান তুলে ধরে শাহাবুদ্দিন শামীম আরও বলেন, ‘গ্র্যান্ডমাস্টার হলেও জিয়া কখনো বেছে বেছে প্রতিযোগিতায় অংশ নিত না। অনেকে আছে প্রাইজমানি কম হলে খেলত না। কিন্তু সে কখনো এভাবে চিন্তা করত না। যে প্রাইজমানিই হোক, সে খেলত। বলত, আমি খেললে অন্যরা খেলার জন্য আসবে।’
বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা বলেন, ‘জিয়ার অকালমৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত। তার যে পবিত্র স্থান, যে স্থানকে সে ভালোবাসত, সেখান থেকেই সে চলে গেল। দাবা খেলা অবস্থাতেই মারা গেল। ভালো একজন খেলোয়াড়কে হারিয়েছি আমরা।’ দাবা ফেডারেশনের সহসভাপতি তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ‘তার এই চলে যাওয়া জাতীয়ভাবে অপূরণীয় ক্ষতি। কারণ দাবার গ্র্যান্ডমাস্টাররাই কিন্তু লাল-সবুজের পতাকা সর্বপ্রথম বিশ্বমানচিত্রে তুলে ধরেছিল।’
জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টা দাবার বোর্ডে জিয়া যার সঙ্গে কাটিয়েছেন, সেই রাজীবও উপস্থিত ছিলেন জানাজায়। রাজীবের গাড়িতে করেই হাসপাতালে নেওয়া হয় জিয়াকে। সারাক্ষণ থমথমে লাগছিল তাকে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। রাজীবের চোখে জিয়াই বাংলাদেশের সেরা দাবাড়ু, ‘আমি মনে করি সে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত সেরা খেলোয়াড়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে আমি মনে করি তার পারফরম্যান্স সবচেয়ে ভালো। বাংলাদেশের দাবা যতদিন থাকবে, সব সময়ই তাকে মনে করবে সবাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করা জিয়া নিজেকে অন্য কোনো পেশায় জড়াননি। নিজে দাবা খেলা এবং কোচিং করিয়ে গেছেন। স্বামীর দাবা ক্যারিয়ারের কথা ভেবেই তার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা লাবণ্য বিসিএস ক্যাডারে যোগদান করেননি। জিয়ার চিরবিদায়ের দিনে তার স্ত্রী-সন্তানদের আর্থিক দিকের কথা বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। বিওএ মহাসচিব শাহেদ রেজা বলেছেন, ‘উনার পরিবারের অর্থনৈতিক যে সমস্যা আছে, এই সমস্যার পাশে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন থাকবে।’ দাবা ফেডারেশনের সহসভাপতি তরফদার রুহুল আমিন ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীমও ফেডারেশনের পক্ষ থেকে জিয়ার পরিবারকে আর্থিক সহায়তার কথা জানিয়েছেন।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে বাবার কবরে শায়িত করা হয়েছে জিয়াকে। এখন তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে।