রাজবাড়ীর ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) অফিসের সামনে গিয়ে দেখা যায় পাঁচ শতাধিক মানুষের দীর্ঘ লাইন। সবাই এসেছেন প্রি-পেইড মিটারের রিচার্জ সংশ্লিষ্ট সমস্যা নিয়ে। কারও মিটার রিচার্জ হচ্ছে না, কারও আবার টাকা কেটে নেওয়া হলেও আসেনি টোকেন নম্বর। এসব সংকটের কারণে অনেকের বাড়িতেই বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। একাধিকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এসেছেন বিদ্যুৎ অফিসে। কিন্তু এত মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য রয়েছে মাত্র একটি কাউন্টার। সব মিলিয়ে তাদের অবস্থা খুবই করুণ।
রবিবার (৩১ মার্চ) বেলা সাড়ে ১১টায় এমন পরিস্থিতি দেখা যায়।
ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজবাড়ী শহরের বিনোদপুরের বাসিন্দা সুজন বিশ্বাস। বলেন, ‘বিদ্যুতের মিটার নিয়ে অনেক ঝামেলায় আছি। সকালে নগদ (মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস) থেকে টাকা রিচার্জ করেছি। টাকা কেটে নিয়েছে, কিন্তু টোকেন নম্বর আসেনি। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। এখন সমাধানের জন্য গ্রাহক সেবা কেন্দ্রে এসে দেখি লম্বা লাইন। একটি মাত্র কাউন্টার থেকে গ্রাহকের সেবা দেওয়া হচ্ছে। পাশে আরও দুটি কাউন্টার রয়েছে। সেখানে লোক থাকলে ভোগান্তি কমত।’
তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ইজিবাইকচালক কাদের শেখ। কান্নাজরিত কণ্ঠে বলেন, ‘ভাই আমার সংসার ইজিবাইকের ভাড়ার টাকায় চলে। বাড়ির মিটার লক হয়ে আছে। গতরাত (শনিবার রাত) থেকে বিদ্যুৎ নেই। ইজিবাইকে চার্জ দিতে পারিনি। সকাল থেকে মিটারের লক খুলতে অফিসে অফিসে ঘুরছি। কখন সমাধান হবে জানি না। এখন ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে আসতে হবে। আমার আজকের সারা দিনের আয় বন্ধ। বিদ্যুৎ নিয়ে এত ভোগান্তি আর সহ্য হয় না।’
রাজবাড়ী শহরে বিদ্যুতের প্রি-পেইড কার্ড রিচার্জ নিয়ে স্থানীয়দের ভোগান্তি দীর্ঘদিনের। ওই এলাকার বেশির ভাগ গ্রাহক মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (বিকাশ, নগদ, রকেট) মাধ্যমে রিচার্জ সংশ্লিষ্ট সেবা নিয়ে থাকেন। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, ‘সার্ভার ডাউন’ থাকার কারণে রিচার্জ করা যায় না। কখনো আবার টাকা কেটে নেওয়া হলেও প্রয়োজনীয় টোকেন নম্বর এসএমএসের মাধ্যমে আসে না। আর ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হিসেবে কখনো চলে আসে ২০০ ডিজিটের টোকেন। বেশির ভাগ মানুষের পক্ষেই মিটারের ছোট ছোট বোতাম টিপে রিচার্জ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
স্থানীয়রা বলছেন, বয়োজ্যেষ্ঠ ও স্বাক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের পক্ষে ২০০ ডিজিটের নম্বর টিপে রিচার্জ করা সম্ভব না। এছাড়া সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও প্রতিমাসে রিচার্জ করতে গেলেই কোনো না কোনো সমস্যা সামনে এসে দাঁড়ায়। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখে সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যদিও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা বলছেন, নেটওয়ার্ক জটিলতার কারণে রিচার্জ করতে সমস্যা হচ্ছে। শিগগিরই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আর যেসব মিটার এখনো অনলাইন হয়নি সেগুলোতে ২০০ ডিজিটের নম্বর আসছে।
ওজোপাডিকো অফিসে রিচার্জ করতে আসা রাজবাড়ী বাজারের সবজি ব্যবসায়ী কুরবান আলী বলেন, ‘সকাল থেকে বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। একজন বিকাশ এজেন্টের কাছ থেকে মিটারে এক হাজার টাকা রিচার্জ করছি। কিন্তু মিটারে টাকা রিচার্জ হচ্ছে না। বিকাশের এজেন্ট বললেন সার্ভারে সমস্যা। দোকান ফেলে রেখে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে এখনো ১৫০ মানুষ। প্রতিমাসেই মিটারে রিচার্জ করতে গেলে এমন সমস্যা হয়। তাহলে ডিজিটাল করে লাভ কী হলো।’
দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘টোকেন নম্বর কখনো আসে ১৮০টি, কখনো আবার ২০০টি। এই নম্বরগুলো মিটারে ইনপুট দিতে হয়। বয়স্ক মানুষের জন্য বিষয়টা খুবই কষ্টের। কখনো একটি নম্বর ভুল হলে আবার প্রথম থেকে ইনপুট দিতে হয়। অনেক সময় একাধিকবার এই ভুল হয়। লেখাপড়া না জানা মানুষের জন্য বিষয়টি খুবই কঠিন। সরকার যখন ডিজিটালই করল তখন রিচার্জ করলেই বিদ্যুৎ আসবে এমন ব্যবস্থা কেন করল না।’
গ্রাহক সেবা কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা বিদ্যুৎ অফিসের সিনিয়র হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বাবর আলী বলেন, ‘প্রতিদিন অনেক মানুষ আমাদের কাছে আসেন। আমরা রিচার্জ করে দেই। রবিবার সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ জন রিচার্জ করেছেন। তাদের পর আরও অনেকে অপেক্ষমাণ ছিলেন।’
রাজবাড়ী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন অর রশীদ বলেন, ‘নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে এমনটি হচ্ছে। শিগগিরই এর সমাধান হয়ে যাবে। যেসব মিটার অনলাইন হয়েছে সেগুলো স্বয়ংক্রিয় রিচার্জ হচ্ছে। আর যেগুলো এখনো অনলাইন হয়নি সেগুলোতে টোকেন নম্বর ইনপুট দিতে হচ্ছে।’