![অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নীতি ও কৌশল প্রসঙ্গে](uploads/2024/07/02/D. Salehuddin Ahmed-1719896493.gif)
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫২ বছরে বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ পর্যন্ত যেসব অর্জন হয়েছে সেগুলোকে সুসংহত করে যেতে আমাদের বর্তমান কতগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু নীতি প্রণয়ন, কৌশল নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন।
সরকারের ২০২৪-২৫ সালের অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে এবং চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তিনটি মূল সমস্যা নিয়ে আমি এতদিন যথেষ্ট আলোকপাত করেছি, সেগুলো হলো- মূল্যস্ফীতি, অপর্যাপ্ত রিজার্ভ এবং জ্বালানি সমস্যা। এগুলোর সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক সমস্যা আছে। যেমন- ব্যাংকিং খাতের সমস্যা, পুঁজিবাজারের সমস্যা, অর্থপাচার এবং দুর্নীতি।
বাজেটে সমস্যাগুলোর সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে তেমন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। পরোক্ষভাবে কিছু কিছু আংশিক নীতি ও কৌশলের উল্লেখ আছে কিন্তু সেগুলো সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। আমার মতে, বাজেট জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। সামনে জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৪-এর মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেটাতেও আমি মনে করি, সমস্যাগুলোর সমাধানে দ্রুত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
রাজস্বনীতিতে যেখানে বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং মুদ্রানীতি, দুটার পেছনেই সঠিক দর্শনের অভাব এবং নীতির সীমাবদ্ধতা আমরা বহুদিন থেকেই লক্ষ্য করছি। সেই সঙ্গে কৌশলগুলোর দুর্বলতা এবং সবশেষে বাস্তবায়নের ব্যর্থতা দিন দিন বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে প্রকট করে তুলছে। এই নিবন্ধে আমি নীতি, কৌশল এবং বাস্তবায়নের প্রসঙ্গে কিছু আলোকপাত করছি।
আর্থিক খাতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এখন আসা যাক বাজেটের পলিসিগত দুর্বলতা প্রসঙ্গে। বাজেটে বিরাট ঘাটতি আছে। ঘাটতি পূরণে সরকারকে কর নিতে হবে বেশি। ঘাটতির জন্য সরকারকে ঋণ নিতে হবে। ঋণ অভ্যন্তরীণ সেক্টর থেকে নেবে। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে বেশি নেবে। বৈদেশিক ঋণ নিয়ে আসবে। কর বাড়াবে, বিশেষ করে পরোক্ষ কর বাড়াবে। প্রত্যক্ষ কর হয়তো কিছু বাড়াবে। করের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। করের যে আদায় এবং কর যে কার কাছ থেকে নেবে- এগুলো সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা দেখতে পেলাম না।
সাধারণত সব দেশে পরোক্ষ কর সবচেয়ে কম ওঠায়। কারণ পরোক্ষ করে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু যারা ধনী, যারা অবস্থাপন্ন, সম্পদশালী, তারা প্রত্যক্ষ কর দেয়। যাদের কর দেওয়ার সামর্থ্য আছে, অর্থ আছে, আয় আছে, তারা দেবে। কিন্তু এটার কোনো কিছুই এখানে ফলো করা হয় না। অতএব, ট্যাক্স বাড়বে, নতুন করে লোকদের ওপর করের বোঝা বাড়বে। এতে কি ট্যাক্স জিডিপি বাড়বে? আমার তো মনে হয় না। কারণ এনবিআরের যে সক্ষমতা, উদ্যোগ ও মনোযোগ থাকবে যারা ট্যাক্স দিচ্ছে, তাদের দিকে।
এখন আসা যাক মুদ্রানীতি এবং রাজস্বনীতির ব্যাপারে। আমার মনে হয়, মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সমন্বয় নেই। কারণ মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক। বাজেট সম্প্রসারণশীল। কিছুটা খরচ বাড়বে, যদিও খুব বেশি বাড়ে না। বিরাট একটা বাজেটঘাটতি আছে। সেই খরচটা কমাতে পারত যদি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আরও কাটছাঁট করে ছোট করে নিয়ে আসা যেত। বাজেটে যে করের হিসাব দিয়েছে, বিভিন্ন প্রণোদনা, সরকারের ঋণ গ্রহণ, সেগুলো মুদ্রানীতির সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক।
এখন মুদ্রানীতিতে কী কী করা উচিত? ভবিষ্যতে কী করতে হবে? ভবিষ্যতে যেটা করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রথমত প্রাথমিকভাবে খুব দ্রুত একটা পর্যালোচনা করতে হবে। মূল্যায়ন করতে হবে। আগের মুদ্রানীতির ইমপ্যাক্টটা কী? এটার জন্য খুব একটা যে সময় লাগবে তা নয়। মুদ্রানীতিটা কী কী কাজে লেগেছে, তাদের উদ্দেশ্য কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে। শুধু মুদ্রানীতিতে আবার কিছুটা টার্গেট দেবে, কিছু রিজার্ভ মানি টার্গেট, ক্রেডিট টার্গেট, পলিসি রেট- সেগুলো দিতে পারবে।
কিন্তু এর আগে পর্যালোচনা করতে হবে, আগের টার্গেটগুলোর কী হয়েছে? এগুলোর ফল কী হয়েছে? আগের কৌশলগুলোর পর্যালোচনা করতে হবে। কারণ গত মুদ্রানীতিতে আমরা তেমন সফলতা দেখিনি। এখন যেসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে কথা বলছি, বাজেটের সময়ে যে বিষয়গুলো সামনে চলে এসেছে, বিভিন্ন বিষয় অ্যাড্রেস করতে হবে। এগুলোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত যেটা হলো, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছি। যেটা আমরা বলছি, চাহিদাটাকে কমানো। চাহিদা যদি কমানো হয়, মূল্যস্ফীতি কমবে। পলিসি রেটগুলো পরিবর্তন করেছে, পলিসি রেটগুলো পরিবর্তন করলে বিশেষ করে প্রাইভেট সেক্টরে অর্থের সরবরাহ কমবে। সুদের হার বৃদ্ধি করেছে। আমাদের সঞ্চয় বা ব্যাংকের জামানতকৃত টাকা কমে যাচ্ছে। ওই দিকে চাহিদা বাড়ছে। ফলে সুদের হার বাড়ছে। সুদের হারটা আগে নয়ছয় ছিল, সেটা মোটেও যুক্তিসংগত ছিল না। সেটা বাড়িয়েছে।
এখন ক্রলিং পেগ করেছে। ক্রলিং পেগ হলো একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় ওঠানামা করবে। কিছুটা বেড়েছে হয়তো, রেমিট্যান্স কিছুটা বেড়েছে ইদানীং। ক্রলিং পেগে ক্রল করে তো বেশি কিছু হয়নি। বিভিন্ন দেশে ক্রলিং পেগের অভিজ্ঞতা তেমন ভালো নয়। ওপরে নামবে, নিচে নামবে। আমাদের মূল সমস্যা- ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটে কেন ওঠানামা করছে? রিজার্ভ কেন কমে যাচ্ছে? বাইরে থেকে ফরেন কারেন্সি কেন আসছে না?
জ্বালানির ব্যাপারটা সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়। কিন্তু জ্বালানির উপাদান তো আনতে হবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা, ডিজেল, পেট্রল আনতে হবে। সেগুলোর জন্য ফরেন রিজার্ভ কতটুকু দরকার, সেটা তো অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচ্য বিষয় হবে।
এর জন্য মুদ্রানীতিতে যেটা দরকার, সেটা করতে হবে। খেলাপি ঋণ সম্পর্কে বাজেটে তো কিছুই তেমন বলেনি। আর বাংলাদেশ ব্যাংক তো খেলাপি ঋণের ব্যাপারে একটার পর একটা ছাড় দিয়েই যাচ্ছে। আমি কিছুদিন আগে এক জায়গায় বলেছিলাম, ‘খেলাপি ঋণ একটা ব্যবসায়িক মডেল হয়ে গেছে।’ এই মডেল একটা ভালো মডেলের বিকৃত রূপ। মডেল হবে ঋণ নেবে, ঋণ ফেরত দেবে। লোকজনের কর্মসংস্থান করবে।
ঋণটা সুস্থভাবে আদায় করবে। ঋণটা শুধু ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হবে না, পুঁজিবাজারের ওপরে হবে। এগুলো কিছু নেই, কিছুই হয়নি। যারা ঋণখেলাপি, তারা ব্যাংক থেকে শুধু ঋণ নিয়ে নিচ্ছে, শোধ দিচ্ছে না। কিন্তু দিন দিন ওদের ব্যবসার প্রসার হয়তো ঘটছে। ব্যবসার প্রসার না ঘটুক, দিন দিন বিপুল পরিমাণে ওদের আয় ও সম্পদ বাড়ছে। এটা বাংলাদেশে অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেউ বলে সারপ্রাইজ, কেউ বলে মিরাকল।
আবার কেউ বলে বাংলাদেশ একটা আদর্শ। ব্যাংকিং মহলে এই আদর্শ বা মিরাকলের ব্যাপারটা অনেক ক্ষুণ্ন করেছে খেলাপি ঋণ। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতটাকে আমূল সংস্কার করতে হবে। খেলাপি ঋণ কী কারণে হচ্ছে? ব্যাংকের সুশাসন কেন হচ্ছে না? বাংলাদেশে কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। মুদ্রানীতি শুধু টার্গেট দিয়ে হবে না। কী কী করবে বাংলাদেশ ব্যাংক, কী কী ব্যাংক করবে- সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।
মুদ্রানীতি ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট সম্পর্কে সুচিন্তিত এবং বাস্তবসম্মত নীতি ও কৌশল দেবে, এটাই কাম্য। আমাদের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ, ফলে সামষ্টিক অর্থনীতি চাপের মুখে আছে। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট মানে সেখানে দেশে বিভিন্ন উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে, সেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। অতএব ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ইমপ্রুভ করতে হলে বাইরে থেকে অর্থ, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ, পুঁজিবাজারে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে।
আমি মনে করি, মুদ্রানীতি এবার ফরেন রিজার্ভ এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে পর্যালোচনার ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করতে হবে। কী কী পদক্ষেপ থাকবে এবং ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ডেভেলপ করার কৌশল থাকবে। ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটটাকে আলাদা করে দেখতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেটটাকে শুধু রেমিট্যান্স আনার ব্যাপারে নয়, আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ সহায়ক করতে হবে। মার্কেট মনিটর করতে হবে।
গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে। টাকাটা কনভার্ট করে ব্ল্যাক মার্কেট থেকে অথবা কার্ব মার্কেট থেকে ডলার কিনে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যারা নানা রকমভাবে অর্থ পাচার করে, হুন্ডি করে, তাদের ধরতে হবে। কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। বিষয়টা শুধু মুদ্রানীতির ব্যাপার নয়, আর্থিক খাতে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা দূর করতে সরকারকে এ ব্যাপারে অতিসত্বর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়নের দুটি মূল গুরুত্বপূর্ণ অর্জন- নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু সামনের দিকে যেতে হলে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের আপামর জনসাধারণের মানোন্নয়ন এবং একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অর্থনীতির সব খাতের নীতির সমন্বয়, কার্যকরী কৌশলের প্রণয়ন, সর্বোপরি বাস্তবায়নের দিকে অতিসত্তর দৃষ্টি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্মিলিত প্রয়াস নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়