রাত ১টা। কুষ্টিয়া শহর। মীর মোশাররফ হোসেন রোড ধরে জনসেবা মোড়ের দিকে এগোচ্ছি। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চিরচেনা রাস্তাটাও কেমন রহস্যময় মনে হচ্ছে। জনমানব নেই বললেই চলে। শুধু দু-একটি বেওয়ারিশ কুকুর রাস্তায় এলোমেলোভাবে ঘোরাফেরা করছে।
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের গেটের সামনে আসতেই আবছা আলোতে দেখতে পেলাম হাতে জলন্ত সিগারেট নিয়ে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম হলের কোনো ছেলেটেলে হবে হয়তো। সামনের দিকে খানিকটা এগোতেই পেছন থেকে গম্ভীর ভরাট কণ্ঠের ডাক শুনতে পেলাম, কে যায়? রাকীব নাকি রে?
অপরিচিত কণ্ঠস্বর। কৌতূহলবশত গেটের সামনে এগিয়ে এসেই আমার আক্কেলগুড়ুম। বিস্ময়ে চোখ কোটর হতে বেড়িয়ে আসার জোগাড়। এ আমি কাকে দেখছি! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। পলিটেকনিকের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই লম্বা চুল, লম্বা দাড়ি। শুধু পরনে ধুতির পরিবর্তে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, হাতে চুরুটের পরিবর্তে বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিগারেটের প্যাকেট, আর গায়ে আলোয়ানের পরিবর্তে স্টাইলিশ টি-শার্ট। টি-শার্টের ওপর লেখা, ‘I am cool’।
আমি বিস্ময়ে খাবি খেতে খেতে কোনোমতো বললাম, গুরুজি আপনার এই অবস্থা কেন?
-কী অবস্থা?
-একেবারে ভোল পাল্টে বসে আছেন।
-হুমম, ওইসব পুরনো পোশাক পরতে আর ভালো লাগে না। তাছাড়া এখন তো আর আগের দিন নেই। ওইসব পরে রাস্তায় বেরোলে লোকে পাগলটাগল ভেবে বসতে পারে।
-তাও ঠিক। তবে আপনার মুখের ভাষা তো চেঞ্জও হয়ে গেছে।
-ওহ সরি, আসলে মেজাজ এত খারাপ যে কিছুই কন্ট্রোল করতে পারছি না।
-যাই হোক, তো আপনি এখানে কেন?
গুরুজি গম্ভীর মুখটা আরও গম্ভীর করে বললেন, একজনকে ছ্যাঁচা দিতে এসেছিলাম।
-কাকে ছ্যাঁচা দেবেন?
-বিশ্বকে
-কোন বিশ্ব?
-কী আশ্চর্য! তুই বিশ্বকে চিনলি না! বিশ্বজিৎ দেবনাথ। তোদের মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের।
-ও আচ্ছা, উনি কী করেছেন?
গুরুজি আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললেন, এতসব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল ফাজিলটা, আর তুই তো দেখি কিছুই জানিস না। ব্যাটা আমার
গান নিয়ে সমালোচনা শুরু করেছে। বলে কিনা, ভেঙে মোর ঘরের চাবি না হয়ে ভেঙে মোর ঘরের তালা হবে। কত্তবড় ফাজিল!
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, বলেন কী!
গুরুজি বললেন, দুই পাতা লেখাপড়া শিখে নিজেকে বিরাট বড় পণ্ডিত মনে করে। ব্যাটা তুমি মেকানিক্স, হাইড্রোলিক্স, থার্মোডাইনামিক্স ভালো বুঝতে পার। তুমি গানের কী বোঝো হে!
-ঠিকই তো।
-আজ ধরতে পারলে পণ্ডিতগিরি ছুটিয়ে দিতাম।
-ধরতে পারেননি?
-নাহ, ব্যাটা আমাকে দেখেই রুমের বারান্দা দিয়ে বাথরুমের পাইপ বেয়ে পালিয়েছে। আমার আবার বাতের ব্যথা। দৌড়াতে পারি না। তাই বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যাচ্ছি। কোথায় যে গেল, বুঝতেই পারলাম না।
আমি সবগুলো দাঁত বের করে বললাম, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্র।
-কী বললি?
-হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্র। কোনো বস্তুর গতি এবং অবস্থান একসঙ্গে জানা সম্ভব না। বিশ্বজিৎ স্যার, ঝেরে দৌড় দিয়েছেন, তার মানে উনি
এখন গতিশীল বস্তু, উনার অবস্থান এখন জানতে পারবেন না।
-হাইজেনবার্গ কে? জাকারবার্গের নাম শুনেছি, হাইজেনবার্গের নাম তো শুনিনি?
-বলেন কী! বিখ্যাত ফিজিসিস্ট। বিরাট জ্ঞানী ব্যক্তি।
গুরুজি বিরক্ত মুখে বললেন, জ্ঞানী না ছাই, বিরাট গাধা।
-গাধা?
-গাধা না তো কী? গাধা না হলে কেউ এরকম থিওরি দেয়? মহাগাধা। এই যে আমি হাঁটতেছি, তার মানে আমি গতিশীল। আর আমার অবস্থান এখন কুষ্টিয়া পলিটেকনিকের সামনে।
আমি আর তর্ক করার সাহস পেলাম না। হাঠাৎ গুরুজির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, চল।
-কোথায়?
-হাইজেনবার্গ গাধাটাকে একটা ছ্যাঁচা দিয়ে আসি।
-উনি তো নেই। ইহধামের মায়া ত্যাগ করেছেন।
গুরুজি মনে হয় একটু আশাহত হলেন। হতাশ গলায় বললেন, গাধাটা বেঁচে গেল। নইলে সেপাই পাঠিয়ে ধরে এনে এমন ধোলাই দিতাম। পিঠের ছাল চামড়া তুলে নিতাম। তবে বিশ্বজিৎকে আমি ছাড়ছি না। আমি আবার আসব, তবে এবার আসার সময় তোকেও সঙ্গে আনব। তুই পাইপের নিচে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকবি। পাইপ বেয়ে পালাতে গেলেই হুড়মুড় করে জাপটে ধরবি। কী, পারবি না?
-পারব না কেন, অবশ্যই পারব। চলুন।
আকাশে পূর্ণচন্দ্র। আমরা দুজনে মনের আনন্দে হেঁটে চলেছি। আজ রাতে একজনকে ছ্যাঁচা দেওয়া হবে।
কলি