২০০৫ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকার শাজাহানপুর ফুটওভার ব্রিজের নিচ থেকে স্থানীয় জনগণ একটি ব্যাগসহ শংকর চন্দ্র দেবনাথ ও জাকির হোসেন নামের দুজনকে আটক করে। তাদের ব্যাগে পাওয়া যায় একটি বালকের কাটা মাথা। পরে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০১৬ সালের মার্চে ওই বালককে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় শংকর ও জাকির হোসেনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ঢাকার বিচারিক আদালত। এরপর নিয়ম অনুসারে মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পাঠানো হয়। পাশাপাশি আসামি হাইকোর্টে আপিল করেন।
২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ মামলায় যেসব পুলিশকে সাক্ষী করা হয়েছিল তারা কেউ সাক্ষ্য দিতে আসেননি।
সে সময়ে আইনজীবী শিশির মনির জানান, সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে না আসায় দুজনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে পুলিশ কেন সাক্ষ্য দিতে এল না, সে জন্য তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) নির্দেশ দিয়েছেন।
জানা যায়, হত্যার শিকার ওই বালকটি গাজীপুর ভাওয়াল শালবনের ছিন্নমূল শিশু। তাকে কেন হত্যা করা হয়েছিল, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি পুলিশি তদন্তে।
পাঁচ বছর আগে হিযবুত তাহরীরের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক মহিউদ্দিনসহ চারজনকে একটি মামলায় বেকসুর খালাস দেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা ওই মামলাটির রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর আপিল করা হবে বলে সেই সময় জানিয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ। তবে আজ পর্যন্ত সেই মামলায় কোনো আপিল দায়ের হয়নি।
শুধু এটিই নয়, সন্ত্রাসবিরোধী দমন আইনের ৮৬ শতাংশ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে গেলেও পরবর্তী আর কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়নি রাষ্ট্রপক্ষ। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়নি একটি মামলায়ও।
একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর দায়ের করা ওই মামলায় আইসিটি ও পাবলিক পরীক্ষা আইনে অভিযোগ আনা হয়েছিল। তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ২৪ জুন ১২৫ জনের বিরুদ্ধে পৃথক আইনে দুটি আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা। সম্প্রতি আইসিটি আইনের অভিযোগ থেকে সব আসামিকে খালাস দেন আদালত।
কারণ হিসেবে আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। মাত্র একজন সাক্ষী আদালতে হাজির হলেও তিনি বৈরী (অপরাধীদের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া) সাক্ষ্য দিয়েছেন।
পুলিশের একাধিক ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে জানান, সাক্ষীর অনুপস্থিতি ও বৈরী সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে অসংখ্য মামলা থেকে সাধারণ থেকে দুর্ধর্ষ আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার তদন্তে ত্রুটি, যথাযথভাবে সাক্ষীদের ব্রিফ না করা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে অনীহা এবং আসামিপক্ষ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েও অনেক সাক্ষী বৈরী সাক্ষ্য দিচ্ছেন। আবার মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক সাক্ষী মারা যান, অনেকেই দূরে বসবাস করার কারণে সাক্ষ্য দিতে আসতে চান না। পুলিশের সাক্ষীদেরও একই অবস্থা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বলছে, সাক্ষীর জন্য সমন জারি করার পরও আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার হার মাত্র ৩৬ দশমিক শতাংশ। বাকি ৬৩ দশমিক ২০ শতাংশ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না।
বৈরী সাক্ষীর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈরী সাক্ষ্য দেওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রকৃত সাক্ষী উপস্থিত না থাকা। তখন বানানো সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। পুলিশ কর্মকর্তারা অনেক সময় যে কাজটি করেন তা হলো- উদ্ধারজনিত মামলা করার সময় সাদা কাগজে সাক্ষীদের স্বাক্ষর নেন। ফলে সাক্ষী হয় আদালতে অনুপস্থিত থাকেন অথবা বৈরী সাক্ষ্য দেন।
ঢাকার আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আনোয়ারুল কবির বাবুল খবরের কাগজকে বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা, ভাসমান লোককে সাক্ষী করা, সাক্ষীর যাতায়াত বা অন্যান্য খরচ বহন না করা ও সাক্ষীকে সমন জারির নোটিশ না পৌঁছানোর কারণে সাক্ষীরা মূলত আদালতে হাজির হতে পারেন না। এ ছাড়া অর্থ দিয়ে আসামিপক্ষ সাক্ষীকে ম্যানেজ করার কারণে বৈরী সাক্ষ্য দিয়ে থাকেন। ফলে দীর্ঘদিন এভাবে একটি মামলা চলতে থাকলে সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। তাই এসব বিষয়ে পুলিশ সদস্যকে আরও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। তবেই যথাযথ সাক্ষীকে হাজির করা সম্ভব হবে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, সর্বশেষ মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় জারি করা সমনের মধ্যে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ সাক্ষীর আদালতে হাজির থাকার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন ডিএমপি কমিশনার। একই সঙ্গে প্রতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জারি করা সমনের কত ভাগ সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, সেই তথ্য উপস্থাপনের জন্য ডিসি প্রসিকিউশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, সাক্ষী হাজির করা খুবই কঠিন একটি কাজ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সাক্ষী অসুস্থ, বয়স্ক, পঙ্গু ও অনেকে মারাও যান। ধরুন, একটি লোকের বাড়ি লালমনিরহাট, তিনি যদি অসুস্থ থাকেন, তবে তাকে আদালতে হাজির করা খুবই কঠিন কাজ।
তিনি বলেন, ‘সাক্ষীদের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হলো তিনি যে সাক্ষী দিতে আদালতে আসবেন সেই খরচ তার কাছে থাকে না। এ ক্ষেত্রে অনেক মামলায় আমরা নিজের টাকা খরচ করে সাক্ষীকে হাজির করেছি, এমনও নজির রয়েছে।’
খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘সাক্ষী হাজিরের ক্ষেত্রে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকি। এ নিয়ে আমাদের সব সময় প্রচেষ্টা ছিল, থাকবে।’