![ফিলিস্তিন হারাতে বসেছে গোটা একটি প্রজন্ম](uploads/2024/01/19/1705685000.plaistinekk.jpg)
তিন মাসে মারা গেছে প্রায় ১০ হাজার শিশু! না, কোনো মহামারিতে নয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর স্থল ও বিমান হামলায় গত অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় মোট প্রাণহানি ঘটেছে ২৪ হাজার ৭০০ মানুষের। এর মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) পর্যন্ত পাওয়া এ হিসাব অনুযায়ী, আহত হয়েছেন অন্তত ৬২ হাজার মানুষ। এসবের সঙ্গে সমান তালে চলছে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের স্থাপনার ধ্বংসযজ্ঞ। বসতবাড়ি থেকে শুরু করে স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়, উপাসনালয়, শরণার্থী শিবির, এমনকি হাসপাতালও বাদ যাচ্ছে না ইসরায়েলি বিমান হামলা থেকে। এ পরিস্থিতিতে আশঙ্কাজনক হারে শিশুমৃত্যু ও তরুণদের শিক্ষাঙ্গন ধ্বংস হওয়ায় একটি ‘প্রজন্ম’ হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এমন মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় চতুর্থ সফর থেকে ফিরে শুক্রবার ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির সম্মুখীন হন ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর কমিশনার জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি। তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় বর্তমানে পাঁচ লাখের বেশি শিশু রয়েছে। কিন্তু এই শিশুরা আবার তাদের পড়াশোনায় কীভাবে ফেরত যাবে, যেখানে তাদের বাসস্থানই সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি আশঙ্কা করছি, আমরা গাজায় একটি প্রজন্মকে হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছি।’
চলতি সপ্তাহে ইসরায়েলি হামলায় আল-ইসরা ইউনিভার্সিটির ভবনটিও গাজার মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। অথচ তারাই ভবনটিকে কয়েক সপ্তাহ ধরে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছিল বলে জানা গেছে। ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর দ্য কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্সের (ওচা) যুদ্ধের প্রভাবের ওপর নিয়মিত বুলেটিনে জানানো হয়, গাজার অন্তত ৬০ শতাংশ বাড়ি বা আবাসন ইউনিট ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতি ১০টি স্কুলের মধ্যে ৯টিরই উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি ভবন, বিদ্যুতের নেটওয়ার্কগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিন মাসে যে পরিমাণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে, তা গত ৭৫ বছরে ফিলিস্তিনিদের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক সংঘর্ষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
২২ বছর বয়সী আমির মোহাম্মদ আল-নাজ্জারি, উত্তর গাজার জাবালিয়ার এই তরুণ সবেমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি শেষ করেছেন। কিন্তু যুদ্ধে আমির ও তার অন্য ভাইবোনের স্বপ্নগুলো ধুলোর মেঘে হারিয়ে গেছে। বিবিসির কাছে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ না হলে এতদিনে আমি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে পারতাম, সম্ভবত আমার চাকরিও হয়ে যেত। আমার ছোট ভাই সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। সে জাতিসংঘের স্কুলে পড়ত, কিন্তু এর কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। আমার আরেক ভাইয়ের স্কুল ফাইনাল এ বছর শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু ওর স্কুলটাও ধ্বংস হয়ে গেছে।’
যুদ্ধে নিজেদের বাসস্থান বিমান হামলায় গুঁড়িয়ে যাওয়ার পর আমির তার পরিবারের সঙ্গে ফিলিস্তিনের দক্ষিণে খান ইউনিসের কাছে একটি অস্থায়ী শিবিরে যেতে বাধ্য হয়েছেণ। আমির বলেন, ‘আমার বোন আল-কুদস বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে তৃতীয় বর্ষে পড়ত, কিন্তু সেখানে বোমা বিস্ফোরিত হয়। আমার ভাইবোন আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে কি না জানি না।’
গাজার এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি। এদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হলো তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। জীবন যেখানে হুমকিতে, সেখানে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভাবাই এখন তাদের জন্য বিলাসিতা।
ফিলিপ লাজারিনি বলেন, ‘যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, ততবেশি বাস্তুচ্যুত গাজাবাসীর দুর্দশা আরও খারাপের দিকে যাবে। আমরা দেখেছি, গাজায় নাগরিকের স্বাভাবিক জীবন-যাপনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। পানি, জ্বালানি, বিদ্যুৎসহ কার্যত সব অবকাঠামো খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই গাজায় মৌলিক জনসেবা আর পাওয়া যাচ্ছে না।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৩টি কার্যকর। এর মধ্যে অনেকগুলো বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত। প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে অনেক রোগী প্রায়ই চিকিৎসা না নিয়েই চলে যান। ওচা বুলেটিনে বলা হয়েছে, ক্যানসার রোগী ও যাদের কিডনি ডায়ালাইসিস বা নবজাতক শিশুর মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার প্রয়োজন, তারা সেখানে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অভিযোগ, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে গাজাকে একটি মরুভূমিতে পরিণত করছে। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে তেলআবিব। কিন্তু জাতিসংঘ কর্মকর্তা ফিলিপ লাজারিনি আশঙ্কা করছেন, যুদ্ধের সার্বিক প্রভাবের কারণে গাজার বাসিন্দাদের অন্যত্র চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
অনেকেরই মত, ইসরায়েল এখন গাজায় জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে। বারবার জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানানো হলেও অভিযান অব্যাহত রেখেছে নেতানিয়াহুর প্রশাসন। ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্রগোষ্ঠী ‘হামাস’ ৭ অক্টোবর অতর্কিত হামলা চালিয়ে জিম্মি করে আনা ইসরায়েলিদের মধ্যে ১০৫ জনকে ছেড়ে দিয়েছে। বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন ২৪০ ফিলিস্তিনি। কিন্তু হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার ব্রত নিয়ে ইসরায়েল ধ্বংসাত্মক অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের সদস্যসহ কয়েকজন বিশিষ্ট ডানপন্থি ইসরায়েলি রাজনীতিবিদ বলেছেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হলো বেসামরিক নাগরিকদের গাজা ছেড়ে মিসর বা অন্যান্য আরব দেশে যেতে উৎসাহিত করা। নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, সম্পূর্ণ বিজয় না হওয়া পর্যন্ত গাজায় তার সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং হামাস গোষ্ঠী ইসরায়েলের জন্য আর হুমকি নয়। একই সঙ্গে তাদের নীতি হিসেবে জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত কোনো ইসরায়েলি গাজায় থাকবে না। কিন্তু ভয়াবহ এই যুদ্ধ শেষে গাজা নামক এই ভূখণ্ডের কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে, তার উত্তর নেই কারও কাছে।
এমএ/