![দ্বৈত নাগরিকত্ব ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট](uploads/2024/05/14/NOMAN-JAKIR-1715664910.jpg)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পৃথিবীর মোট ১০১টি দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবেন। অর্থাৎ, বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশের পাসপোর্ট রাখার পাশাপাশি আরও ১০১টি দেশের মধ্য থেকে যেকোনো দেশের পাসপোর্ট বহন করতে পারবেন।
বাংলাদেশের নাগরিকরা বিশ্বায়নের এই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরা বেশির ভাগই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন কাজের সন্ধানে। তারা যদি সেই উন্নত দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, তবে তারা সেখানে তুলনামূলক সহজভাবে কর্মসংস্থান খুঁজে নিতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যও চালু করতে পারবেন। এই ব্যবসার পরিসর বাংলাদেশেও আসার সম্ভাবনা অস্বাভাবিক প্রত্যাশা নয়। বরং এই প্রত্যাশা এখন বাস্তবতা।
তাই, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ দেওয়ার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। একটি জাতীয় দৈনিকে দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগ) মো. হাবিবুর রহমানের বক্তব্য এই প্রবন্ধে পুনরায় প্রকাশ করার লোভ সামলাতে পারছি না। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে তিনি বলেন, দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণকারী প্রবাসীরা সেসব দেশে ভালভাবে আয়-রোজগার করার সুযোগ-সুবিধা পাবেন এবং দেশে অর্থ পাঠাবেন, তাতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্ব নাগরিক বিবেচনায় গ্লোবাল ভিলেজে কেউ দ্বৈত নাগরিক হতে চাইলে দেশের স্বার্থ ঠিক রেখে সে সুযোগ দেওয়া উচিত, যা বাংলাদেশ ‘নাগরিকত্ব আইন-২০১৬’ বিলের মাধ্যমেও অনুমোদিত।
আর তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, প্রযুক্তি ও জ্ঞানের আদান-প্রদান। দ্বৈত নাগরিকরা উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার দেশে প্রয়োগ করতে পারবেন এবং দেশের বিভিন্ন প্রযুক্তিনির্ভর খাতে প্রযুক্তির ব্যবহারে দিকনির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ করার লক্ষ্যেও আকৃষ্ট হবেন। সেই সঙ্গে দেশের সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক পারে দেশকে প্রযুক্তি ও জ্ঞানে আরও সমৃদ্ধ করতে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বেশির ভাগ নাগরিকই কীভাবে একই সঙ্গে নতুন নাগরিকত্ব পাওয়া দেশের পাসপোর্ট ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট অব্যাহত রাখবেন কিংবা কীভাবে বাংলাদেশে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, সে বিষয়ে অসচেতন।
অথচ খুব সহজেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের জন্য আবেদন করা যায়। আবার অফলাইনেও আবেদন করার প্রক্রিয়া রয়েছে। অনলাইনে আবেদন করলে কীভাবে আবেদন করতে হবে, কী কী ডকুমেন্টস দিতে হবে সব নির্দেশনা ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে।
তাছাড়া, বর্তমানে অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে বিদেশের যেকোনো জায়গা থেকে দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদের আবেদন করা যায়, যা বিগত দিনগুলোতে সংশ্লিষ্ট দেশের মিশনের মাধ্যমে করা হতো। এতে করে প্রবাসী সেবাপ্রত্যাশীদের দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা টিকিয়ে রাখতে অনেক ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হতো এবং প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় হতো।
বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ‘সোনালী পেমেন্ট গেটওয়ে’ অ্যাপের সঙ্গে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও পুলিশের বিশেষ শাখার সংযোগ থাকায় পেমেন্ট সংক্রান্ত ভোগান্তি থেকে রেহাই পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বৈত নাগরিকরা খুব সহজেই দেশ-বিদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্যাংকিং লেনদেন করতে পারবেন এবং সনদ প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও প্রয়োজনীয় কাজগুলো অতিদ্রুত সম্পন্ন করতে পারেন। এতে করে প্রবাসীরা দ্বৈত নাগরিকত্ব টিকিয়ে রাখতে আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী হবেন।
বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদ দিয়ে একজন ব্যক্তি বাংলাদেশের পাসপোর্টের জন্যও আবেদন করতে পারবেন কিংবা তার ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পাসপোর্ট থাকলে, সেই পাসপোর্ট খুব সহজেই নবায়ন করতে পারবেন। সুতরাং, পাসপোর্ট সংক্রান্ত ভোগান্তি থেকেও খুব সহজেই দ্বৈত নাগরিকরা মুক্তি পাবেন।
আবার অনেক দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণকারীর বাংলাদেশের পাসপোর্ট গ্রহণের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদ গ্রহণেরও প্রয়োজন হয় না। এসআরও নম্বর ২৭০-আইন/২০০৮ অনুযায়ী বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যদি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তথা জার্মানি, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, চেকপ্রজাতন্ত্র, গ্রিস, পর্তুগাল, সুইডেন, হাঙ্গেরি, বেলারুশ, অস্ট্রিয়া, সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, মোলদোভা, বসনিয়া, আলবেনিয়া, লিথুয়ানিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, স্লোভেনিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, মন্টিনিগ্রো, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, আইসল্যান্ড, অ্যান্ডোরা, মোনাকো, লিচেনস্টাইন, সান মারিনো, কসোভো, ইংল্যান্ড, এনডোরা, সাইপ্রাস, আর্মেনিয়া এবং জর্জিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, তখন পাসপোর্টের আবেদনের জন্য তাদের আর নতুন করে দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদ প্রদান করতে হবে না। পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এসআরও নম্বর ২৭-আইন/২০১২ অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিক যারা এশিয়ার আরও সাতটি দেশ তথা হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করবেন, তাদের ক্ষেত্রেও পাসপোর্টের আবেদন করার সময় দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের প্রয়োজন হবে না মর্মে গেজেট প্রকাশ করে।
আবার নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নির্বাচন সহায়তা-২ শাখার ১২ এপ্রিল ২০২২ তারিখের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের পাসপোর্ট গ্রহণের সময় দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের প্রয়োজন হবে না। উপরিউক্ত সব দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের শপথ গ্রহণে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বিষয়ে কোনো বক্তব্য থাকতে পারবে না, মর্মে সব গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি তারা এমন শপথ গ্রহণ করে থাকেন, তখন বাংলাদেশের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে তাদের ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদের প্রয়োজন হবে।
দ্বৈত নাগরিকত্ব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, তাই এর সঠিক ব্যবহার এবং সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে দ্বৈত নাগরিকদের অবহিত করা অত্যন্ত জরুরি। ঠিক তেমনি দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদপ্রাপ্তিও যেন ভোগান্তির কারণ না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর দিতে হবে।
তবে দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন, যেন কোনো অসাধু ব্যক্তি এর সুযোগ না নিতে পারে। আর এই জন্য ‘নাগরিকত্ব আইন ২০১৬’ অতি দ্রুত বলবৎ করা উচিত। এতে করে নাগরিকত্ব এবং দ্বৈত নাগরিকত্ব দুটি বিষয়ই সার্বিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এগুলোর সুব্যস্থাপনা নিশ্চিত করা যাবে এবং নাগরিকরাও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারবেন। একই সঙ্গে দ্বৈত নাগরিকদের পাসপোর্ট সংক্রান্ত ভোগান্তিও অনেকাংশে কমবে।
লেখক: উপ-পরিচালক
বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, বরিশাল
[email protected]