মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। অনেকের ক্ষেত্রে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক। প্রার্থীর হলফনামায় দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। শুধু তাই নয়, হলফনামায় সম্পদের যে মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে, তার সঙ্গে প্রকৃত মূল্যের বিস্তর ফারাক।
হলফনামায় সম্পদ অর্জনকালীন মূল্য দিতে বলায়, বর্তমান মূল্যের তফাত সহজেই অনুমেয়। বর্তমান সরকারের ৫ জন মন্ত্রীর হলফনামা দেখে এই ধারণা পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নির্বাচন কমিশনের নিয়মে প্রার্থীরা সম্পদের হিসাব দিলেও এগুলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খতিয়ে দেখতে পারে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান খবরের কাগজকে বলেন, প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনের নিয়মে সম্পদের হিসাব দাখিল করলেও সম্পদের মূল্য কম দেখানো আইনসম্মত নয়। এসব বিষয়ে যদি দুদকে অভিযোগ ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত আসে, তাহলে দুদক আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে। কারণ, এটি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে পড়ে। এ ছাড়া, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্টদের আয়কর রিটার্নের সঙ্গে হলফনামার তথ্যের কোনো গরমিল আছে কি না সেটা খতিয়ে দেখতে পারে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক
মানিকগঞ্জ-৩ আসনের বর্তমান এমপি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক তার হলফনামায় বনানী বাণিজ্যিক এলাকায় ২৯ কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে জমিসহ ১৬ তলা ভবনের ১১ তলা মালিকানার মূল্য দেখিয়েছেন ৩ কোটি ৬১ লাখ ৬ হাজার ২২ টাকা। মোহাম্মদপুর পিসিকালচার হাউজিং সোসাইটিতে আড়াই কাঠা জমির মূল্য দেখিয়েছেন ৭০ হাজার টাকা। যা বর্তমান বাজার মূল্যের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সম্পদ বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করলে এই সম্পদের পরিমাণ আরও বহু গুণ বাড়বে।
নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, তার আয় বেড়েছে সাড়ে ১১ গুণ, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান বা অন্যান্য ভাড়া, ব্যবসা, প্লট, অ্যাগ্রো ফার্ম, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানত, ডিভিডেন্ড এবং অন্যান্য (এমপির সম্মানী ভাতা) বাবদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাৎসরিক আয় বর্তমানে ৮ কোটি ২৯ লাখ ৯৭ হাজার ২৫ টাকা। যা ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় ছিল ৭১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯১ টাকা। গত ১৫ বছরে তার বার্ষিক আয় বেড়েছে ৭ কোটি ৫৮ লাখ ৬২ হাজার ৩৩৪ টাকা। অর্থাৎ সংসদ সদস্য থেকে প্রতিমন্ত্রী, এরপর মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে গত ১৫ বছরে তার বার্ষিক আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৩ গুণ। বেড়েছে সম্পদও। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, তিনি ছিলেন ৬ কোটি ৭৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫৭ টাকার মালিক। গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩ কোটি ৫৫ লাখ ১৩ হাজার ৬০৪ টাকা।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক
গাজীপুর-১ আসনের বর্তমান এমপি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হকের ঢাকায় ১০ তলা ফাউন্ডেশনের দোতলা আবাসিক ভবনের মূল্য ১ কোটি ৪৩ লাখ ৩৮ হাজার ৯০০ টাকা। ১ হাজার ৫৬৮ বর্গ ফুটের একটি দোতলা দালান রয়েছে যার মূল্য ৪০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ৯৬০ বর্গফুটের আধাপাকা একটি টিনশেড বাড়ি রয়েছে, যার মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র দেড় লাখ টাকা। ৭ ভরি স্বর্ণের মূল্য দেখানো হয়েছে ১ লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা। যা বর্তমান মূল্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। হলফনামা অনুযায়ী, গত ৫ বছরে তার বাড়ি ও জমির পরিমাণ অনেক বেড়েছে।
২০১৮ সালে নির্বাচনী হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেন, কৃষি খাত থেকে আয় ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, ভাড়া বাবদ আয় ৩৬ হাজার টাকা, পোলট্রি থেকে আয় ১৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা, নিজ নামে শেয়ার সঞ্চয়পত্র/ ব্যাংক আমানত/ ব্যাংক সুদ ২৬ হাজার টাকা, পারিতোষিক ও ভাতাদি থেকে আয় ২৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৮০ টাকা। নিজের নগদ টাকা ছিল ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩১ টাকা। ব্যাংকে জমা ছিল ১৭ লাখ ৭৭ হাজার ৭৩ টাকা। স্ত্রীর ছিল ৭ লাখ ৩৬ হাজার ৯০৪ টাকা। নিজ নামে ১০ তোলা ও স্ত্রীর নামে ছিল ১২ তোলা স্বর্ণ। তিনটি গাড়ির মধ্যে একটির মূল্য ছিল ৯২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, আরেকটির মূল্য ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা তৃতীয়টির মূল্য ৪২ লাখ টাকা।
পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী
হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনের সংসদ-সদস্য এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী ঢাকায় ৪ তলা ভবনের মূল্য দেখিয়েছেন ৩৬ লাখ টাকা। গ্রামে ২৪ বিঘা জমির মূল্য দেখিয়েছেন ৪ লাখ টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশের কোথাও সম্পদের মূল্য এত কম দেখা যায়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার নির্ভরশীলদের কোনো সম্পদ ছিল না। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তার স্ত্রীসহ নির্ভরশীলদের নামে রয়েছে পৌনে ২ কোটি টাকার সম্পদ।
সম্পদের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে চা বাগান, রাবার বাগান ও মৎস্য খামার। আয় ও সম্পদ ৮ গুণ বেড়েছে। তার স্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে সাড়ে ২৫ গুণ। তার ৩০ ভরি স্বর্ণ এবং স্ত্রীর ৩০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার আছে। এসবের মূল্য উল্লেখ করা হয়নি।
এলজিআরডি মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম তার হলফনামায় স্থাবর সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ না করলেও সে সবের অর্জনকালীন মূল্য উল্লেখ করেছেন। বর্ণনা অনুযায়ী, স্থাবর সম্পদ রয়েছে ২১ কোটি ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকার। এর মধ্যে কৃষিজমি ১ কোটি ৫১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫২ টাকার এবং আবাসিক-অনাবাসিক বহুতল ভবনের মূল্য ২০ কোটি ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। দলিলে উল্লেখ করা এসব মূল্যের সঙ্গে বর্তমান মূল্য অনেক বেশি হওয়ার কথা।
মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এখন ১১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকার সম্পদের মালিক। বছরে চার কোটি টাকার বেশি আয় করেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় বছরে ১৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা আয় করলেও এখন আয় করেন ৪ কোটি ১৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এর মধ্যে শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে আসে ১ কোটি ৬৩ লাখ ৮৯ হাজার টাকা, ব্যবসা থেকে ১৪ লাখ ২৪ হাজার, কৃষি থেকে ৩ লাখ ৩৫ হাজার এবং বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া থেকে ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা আয় করেন তিনি। এ ছাড়া সংসদ সদস্য ভাতা পেয়েছেন ১৫ লাখ ৫৯ হাজার ও পোলট্রি খাত থেকে আয় করেন ৫১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৩ (সদর ও হাইমচর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঢাকার ধানমন্ডিতে দুটি ফ্ল্যাটের মূল্য দেখিয়েছেন ৩৫ লাখ টাকা। তার নামে স্থাবর সম্পদের মধ্যে ৩৪ লাখ এক হাজার ৯৫৭ টাকা মূল্যের ১০ কাঠা জমি আছে। ২৫ তোলা স্বর্ণের মূল্য দেখানো হয় ৯ লাখ টাকা। তার স্বামীর নামে ১৫ লাখ টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট দেখানো হয়; যা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তার নিজের আসবাবপত্র রয়েছে এক লাখ টাকার এবং স্বামীর নামে কেনা আসবাবপত্রের মূল্য দেখানো হয়েছে ১০ লাখ ৫ হাজার টাকা।