![ঘর থেকেই ব্যবস্থা চান আ.লীগ নেতা-কর্মীরা](uploads/2024/07/04/awami-league-1720068903.jpg)
আগে ঘর (দল) থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চান আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। কারণ হিসেবে দলটির তৃণমূল নেতারা বলছেন, অসৎ নেতারা বিদায় হলে সৎ ও যোগ্য নেতারা দায়িত্বশীল পদে আসবেন। এতে করে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী হবে আওয়ামী লীগ।
কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতির চিত্র গণমাধ্যমে উঠে আসায় সাম্প্রতিক কালে সরকারের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এ পরিস্থিতিতে দুর্নীতির অভিযোগ বা আলোচনা আছে আওয়ামী লীগের, এমন নেতারাও চিন্তিত হয়ে পড়েন। কারণ অভিযান কোথা থেকে শুরু হবে, তা নিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা ও গুঞ্জন শুরু হয়। তবে ক্লিন ইমেজের নেতারা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় একজন অন্যজনকে বলেন, দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দুর্নীতিবাজ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। তারা বলেন, আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে কেউ কেউ অসৎ পথে অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন; যেটি জনগণের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে। ওই নেতারাই আবার দায়িত্বশীল পদে থেকে পদ-বাণিজ্য করে অযোগ্যদের দলে টেনেছেন, এমন আলোচনাও আছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানের বিষয়ে আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন। দলের নেতারা দুর্নীতি করলে তাদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা হবে, তা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভালো বলতে পারবেন। তবে সব জায়গাতেই জিরো টলারেন্স নীতি থাকতে হবে।’
টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের আগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনি ইশতেহার দিয়েছিল, তাতে গুরুত্ব পেয়েছিল ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি’।
গত শনিবার সংসদে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি, সে যেই হোক দুর্নীতি করলে কারও রক্ষা নেই। যারাই দুর্নীতি করবে, ধরব।’
গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান পরিষ্কার, জিরো টলারেন্স। এ ক্ষেত্রে তিনি অটল। দুর্নীতি যেই করুক, সে ক্ষেত্রে সরকার জিরো টলারেন্স নীতিতে থাকবে। দুর্নীতির তদন্ত করার অধিকার দুদকের রয়েছে। এখানে সরকার তাদের স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।
নেতাদের ক্ষেত্রে কী হবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দুর্নীতি শুধু আমলারা করেন, রাজনীতিবিদরা করেন না- সেটা নয়। যখন আমরা কথা বলি, তখন আয়নায় নিজেদের চেহারাও দেখা উচিত যে আমি একজন পলিটিশিয়ান দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছি, কিন্তু আমাদের মধ্যেও তো করাপশন রয়েছে।’
দলীয় সূত্র বলছে, ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার ভারতের মাটিতে নৃশংসভাবে খুন হওয়ার কারণ হিসেবে দুর্নীতি-লুটপাটের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের বিষয়টি উঠে আসে। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের পদ-বাণিজ্যের একটি ‘কল রেকর্ড’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের শীর্ষ পদ পেতে আকবর আলী নামের এক নেতা মহানগর উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের মোবাইলে ফোন করেন। সেখানে ওয়ার্ডের সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক পদে থাকার জন্য আকবর আলী বজলুর রহমানকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে রেকর্ডটিতে শোনা গেছে। খোদ সভাপতির এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এর আগে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে নাম জড়িয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ। দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীর অনুসারী হওয়ার সুবাদে তার নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি, দৃশ্যমান ব্যবসা না থাকলেও রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট-গাড়ির মালিক, নারীদের কুপ্রস্তাব দেওয়া, সিনিয়র নেতাদের অসম্মান করাসহ রিয়াজের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ করেন নগর নেতারা। শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দলীয় পদ থেকে রিয়াজকে বহিষ্কারও করে আওয়ামী লীগ। তার পরও ক্ষান্ত হননি রিয়াজ। দলের শীর্ষ নেতাদের ম্যানেজ করে পদে ফিরেছেন তিনি। সর্বশেষ দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী ও কাউন্সিলর সৈয়দা রোকসানা ইসলাম চামেলীকে দলে ফেরাবেন বলে ১০ লাখ টাকায় রফাদফা করতে চেয়েছিলেন রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ। এ ঘটনায় তাকে শোকজ করা হলে তিনি নেতাদের ম্যানেজ করে স্বপদে ফিরছেন বলে জানা গেছে। তাকে যারা প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তাদেরও বিচার চেয়েছেন নগরের তিনজন নেতা।
অন্যদিকে আলোচিত ছাগলকাণ্ডে উঠে আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমানের দুর্নীতির খবর। তার দুই স্ত্রীর বিপুল সম্পদের খবর সারা দেশে আলোড়ন তৈরি করে। তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। যিনি জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদেও রয়েছেন। তার নামে-বেনামে রয়েছে অঢেল সম্পদ। অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক হয়ে কীভাবে লায়লা এত সম্পদের মালিক বনে গেলেন, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে নেতাদের মধ্যে বিস্তর আলাপ-আলোচনা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। তার বিরুদ্ধে কেনো দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, সে বিষয়ে কথা বলছেন নেতারা।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, লায়লা কানিজের এখনো দলীয় পদ ও উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আসীন থাকা নিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা এ জন্য একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। যদিও লায়লা বিএনপি এবং রাজাকার পরিবারের সন্তান বলে জানান নরসিংদী জেলার আওয়ামী লীগের নেতারা।
বিতর্কিত ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে কঠোর দেখতে চান দলের তৃণমূল নেতারা। চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘যাদের সুবিধার কারণে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক, সেটাই আমরা চাই।’
গত শনিবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগে যদি কোনো আবর্জনা-আগাছা হাজির হয়, তবে তা আমরা উপড়ে ফেলব। আগাছামুক্ত আওয়ামী লীগ গড়ব।’
বাহাউদ্দিন নাছিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তো বলছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। যাকে বলা যেতে পারে শুভ জাগরণ। আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান তো সবার জন্যই হবে। কারণ আইন তো সবার ক্ষেত্রে সমান।’ দলীয়ভাবে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে নাছিম বলেন, ‘দলের কেউ দুর্নীতিবাজ প্রমাণিত হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কার করা হবে। আর সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার এগুলোও দুর্নীতির অংশ। দলীয়ভাবে কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয়স্বজনকে নির্বাচনে না দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে। কিন্তু সেই আহ্বানেও সাড়া দেননি অনেক মন্ত্রী-এমপি। এখন দেখা হবে কোন কোন সংসদ সদস্য কোথায় কোথায় কী কী অপকর্মের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি দলীয়ভাবেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দলের মধ্যে দুর্নীতিবাজ থাকলে তার কোনো তালিকা তৈরি করবেন কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ যে পেশার হোক, তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। এটি রাষ্ট্রীয় ম্যাকানিজমে হচ্ছে।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী দলের ভেতরে হোক, সরকারে, প্রশাসনে, অন্য পর্যায়ে- দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান জিরো টলারেন্স থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য বের হলে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’