![২০ দিন নেতৃত্বশূন্য বিএনপির চার মহানগর ও যুবদলের কমিটি](uploads/2024/07/04/bnp-1720069215.jpg)
বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আবারও মাঠের আন্দোলনে ফিরেছে বিএনপি। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা মহানগরের দুই অংশেই নেতৃত্ব নেই ২০ দিন ধরে। একই অবস্থা চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগরেও। নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় জাতীয়তাবাদী যুবদলও।
গত ১৩ জুন আকস্মিক বিলুপ্তির পর থেকেই দলীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল দ্রুততম সময়ের মধ্যেই ঘোষণা করা হবে এসব কমিটি।
অনেকেই জানিয়েছিলেন, নতুন নেতৃত্ব ঠিক করেই কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। নতুন কমিটি শুধু ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে।
ফলে যেকোনো সময় নতুন কাণ্ডারি পাবে এসব ইউনিট আর নতুনভাবে উজ্জীবিত হবেন নেতা-কর্মীরা। কিন্তু ২০ দিন পার হয়ে গেলেও এখনো নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা করতে পারেনি দলের হাইকমান্ড। এরই মধ্যে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছে দলটি।
তবে দলীয় সূত্র বলছে, হঠাৎ করে বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় কমিটি ঘোষণা থেকে বিরত থাকে হাইকমান্ড। দলের সর্বোচ্চ নেত্রী গত মঙ্গলবার পর্যন্ত হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিলেন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে বড় রদবদল ও একাধিক কমিটি বিলুপ্তির ঘটনায় দলের ভেতরে ও বাইরে নানা আলোচনার কারণেও কিছুটা সময় নেওয়া হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, ধীরে চলো নীতির মাধ্যমে কমিটিতে আসতে ইচ্ছুক নেতাদের পারফরম্যান্স আরেকবার মূল্যায়নের একটা কৌশল নিচ্ছেন নীতিনির্ধারকরা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় খবরের কাগজকে বলেন, সাংগঠনিক কাঠামোর অংশ হিসেবে দলে ভাঙা-গড়া চলে। সময়মতো আবার নতুন কমিটি দেওয়া হবে। সাময়িকভাবে কমিটি না থাকলেও দলের কার্যক্রমে তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না। দলের জন্য ভালো ও সুন্দর একটা কমিটি দিতে একটু সময় লাগছে।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, বেগম জিয়ার মুক্তিসহ নানা দাবিতে টানা আন্দোলন করে বিএনপি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে একাধিক সফল কর্মসূচি পালন করে দলটি। বিশেষ করে বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে বিএনপি ও অন্যান্য অঙ্গসহযোগী সংগঠনের শোডাউন ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গত বছরের ২৮ অক্টোবরের ঢাকায় মহাসমাবেশের পর পাল্টে যায় পরিস্থিতি। বিএনপি ও বিরোধী জোটের হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ তেমন ছিল না বললেই চলে। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু নেতা-কর্মী ঝটিকা মিছিল করে দায়িত্ব শেষ করেন। আবার বেশির ভাগ পদধারী নেতা চলে যান আত্মগোপনে। ফলে শেষ পর্যন্ত আবার ব্যর্থতার দায় চলে আসে ঢাকা মহানগরসহ অনেক কমিটির ওপর। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে মূলত বড় পদধারীদের নিষ্ক্রিয়তায় ক্ষুব্ধ হাইকমান্ড। তাদের সরাতে গিয়ে ভেঙে দেয় কমিটি। গত ১৩ জুন ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ, বরিশাল, চট্টগ্রাম মহানগর ও যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। যদিও গত শনিবারের সমাবেশ সফল করতে যে প্রস্তুতি সভা হয়, সেখানে বিলুপ্ত কমিটির নেতাদের সঙ্গেই বৈঠক করেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা।
বিএনপির ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইয়েদুল আলম বাবুল খবরের কাগজকে বলেন, ‘কমিটি নিয়ে যখন শীর্ষ নেতৃত্ব কাজ শুরু করেছেন, তখনই আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ফলে এমন অবস্থায় দল তাকে নিয়েই ভাববে, এটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি তাকে যেহেতু সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আটক রাখা হয়েছে, ফলে নেত্রীকে মুক্ত করার আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, খুব শিগগির পর্যায়ক্রমে কমিটিগুলো দেওয়া হবে।’ কমিটি না থাকার প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দলের সত্যিকার নিবেদিত নেতা-কর্মীরা কখন পদে আছেন, কখন নেই এসব নিয়ে ভাবেন না। দলের ডাকে সর্বাবস্থায় তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। সর্বশেষ ২৯ জুন মাত্র দুই দিনের নোটিশে ঢাকায় আমরা যে বড় কর্মসূচি পালন করেছি এটা তার প্রমাণ।’
১০ দিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর মঙ্গলবার বেগম জিয়া বাসায় ফিরেছেন। ফলে তাকে নিয়ে খানিকটা স্বস্তিতে বিএনপির হাইকমান্ড। তাই দলের নেতারা আশা করছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘোষণা আসতে পারে নতুন নেতৃত্বের।
বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বিলুপ্ত কমিটির সদস্যসচিব রফিকুল আলম মজনু বলেন, ‘কমিটি না থাকলেও আমাদের নেতৃত্বে কোনো সমস্যা নেই। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি। দেশনেত্রীর মুক্তির দাবিতে সর্বশেষ যে সমাবেশ হয়েছে, সেখানেও আমরা সবাই একসঙ্গে কর্মসূচি পালন করেছি। তবে বড় সংগঠনে যত তাড়াতাড়ি কমিটি দেওয়া যায়, ততই ভালো। এতে চেইন অব কমান্ড ঠিক থাকে। মিছিল-মিটিং ঠিকভাবে করা যায়। না হলে চাইলেই সব কাজ করা সম্ভব হয় না।’
দেরি হওয়ায় শুরু হয়েছে তদবির-লবিং
এদিকে কমিটি গঠনে কিছুটা দেরি হওয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা নিজেদের মতো লবিং-তদবির করে নিজের অবস্থান শক্ত করা বা অন্যকে পেছনে ফেলার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপিতে সদ্য সাবেক সদস্যসচিব আমিনুল হককে সভাপতি বা আহ্বায়ক করা হবে, এমন জোর আলোচনা শোনা গেলেও সম্প্রতি কারামুক্ত হওয়ায় যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরবকে এই পদে দায়িত্ব দিয়ে আমিনুল হককে আবারও সদস্যসচিব করা হবে বলে কেউ কেউ বলছেন। এ ছাড়া শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে নিয়েও দল ভাবছে, এমন আলোচনা শোনা গেলেও তারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে ভালো পদ পেয়েছেন। তবে তাবিথ আউয়াল, আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, এম কফিল উদ্দিন আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান সেগুন, এ জি এম শামসুল হক, এস এম জাহাঙ্গীরকে যোগ্যতম অবস্থানে রেখে কমিটি গঠন করা হতে পারে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে দক্ষিণের সাবেক আহ্বায়ক আবদুস সালামের নতুন কমিটিতে বাদ পড়া নিশ্চিত বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে। বিএনপির নগর-সংশ্লিষ্টদের মতে, নতুন কমিটির শীর্ষ পদে নগর বিএনপির সাবেক নেতা নবীউল্লাহ নবী, কাজী আবুল বাশার, রফিকুল আলম মজনু, তানভীর আহমেদ রবিন, হাবিবুর রশিদ হাবিব, হামিদুর রহমান হামিদ, ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন ও লিটন মাহমুদকে দেখা যাবে।
দক্ষিণ বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মহানগরের রাজনীতির সঙ্গে আছি। কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে প্যানেল মেয়রও ছিলাম। আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছি। সামনেও দলের জন্য কাজ করতে চাই।’
চট্টগ্রাম মহানগর কমিটিতে নগর বিএনপির সিনিয়র সদস্য এরশাদ উল্লাহ, যুগ্ম আহ্বায়ক নাজিমুর রহমান, এস এম সাইফুল ইসলাম ও আবুল হাশেমের নাম শোনা যাচ্ছে। আবার ডা. শাহাদাত আহ্বায়ক থাকতে পারেন, এমন আলোচনাও জোরালো।
অন্যদিকে বরিশাল মহানগর বিএনপির নতুন কমিটিতে আলোচনায় আছেন সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার জাহান শিরিন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, সাবেক সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবির, যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়া উদ্দিন সিকদার প্রমুখ।
যুবদলে নতুন নেতৃত্বের মধ্যে বিদায়ী কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সহসভাপতি নুরুল ইসলাম নয়ন, শফিকুল ইসলাম মিল্টন, এনামুল হক এনাম, গোলাম মাওলা শাহীনের কথা শোনা যাচ্ছে।
মামুন হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘দল যদি আস্থা রেখে দায়িত্ব দেয়, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। অতীতেও সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও বাস্তব পরিস্থিতির কারণে হয়তো অনেক কিছু করতে পারিনি, কিন্তু কমিটমেন্টের ঘাটতি ছিল না।’