![কোরবানিদাতার কাছে আল্লাহ যা চান](uploads/2024/06/08/qurbao-1717837626.jpg)
কোরবানির মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে রাজি আছে কি না, সেটিই পরীক্ষার বিষয়। কোরবানি আমাদের সেই পরীক্ষার কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে আল্লাহর পরীক্ষাও ছিল সেটাই। আমাদের এখন আর সন্তান কোরবানি দেওয়ার মতো এত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় না। শুধু একটি জবাইয়ের উপযুক্ত হালাল পশু কোরবানি করেই আমরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি। ঈমানের এসব কঠিন পরীক্ষায় যারা যত বেশি নম্বর অর্জন করতে পারেন, তারাই হন তত বড় আল্লাহপ্রেমিক ও আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ততই সফল। ঈদের প্রকৃত আধ্যাত্মিক আনন্দ তারা ঠিক ততটাই উপভোগ করতে পারেন, যতটা তারা এ জাতীয় পরীক্ষায় সফল হন।
কোরবানি আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতার মাধ্যম
কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে সওয়াব লেখা হয়। আল্লাহর কাছে কোরবানির সওয়াব গ্রহণীয় হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে, পূর্ণ ঈমান ও ত্যাগের মহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে ইবরাহিম (আ.) স্বীয় প্রাণাধিক প্রিয় ছেলের কাঁধে ছুরি চালিয়েছিলেন, কোরবানির পশুর গলায় ছুরি দেওয়ার সময় কোরবানিদাতার মনটা সেই মানসিকতা ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত হতে হবে। আর যদি তার দেহ-মনের পরতে পরতে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের আকুল আগ্রহ উদ্বেলিত না হয়, তাহলে তার এই কোরবানির উৎসব নিছক গোশত খাওয়ার জন্যই হবে। সেজন্যই আল্লাহতায়ালা কোরবানিদাতাদের সাবধান করে বলেন, ‘কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছায় কেবল তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)
কোরবানি আত্মত্যাগের অনন্য উপমা
কোরবানি শুধু পশু জবাই করার নাম নয়। নিজের পশুত্ব, ক্ষুদ্রতা, নীচুতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, আমিত্ব ও অহংকার ত্যাগের নাম কোরবানি। নিজের নামাজ, কোরবানি, জীবন-মরণ ও যাবতীয় বিষয়-আশয়—সবকিছুই শুধু আল্লাহর নামে তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য চূড়ান্তভাবে নিয়োগ ও ত্যাগের মানসিকতা এবং বাস্তবে সেসব আমল করাই হচ্ছে প্রকৃত কোরবানি। এই কোরবানি পশু জবাই থেকে শুরু করে নিজের ভেতরকার পশুত্ব জবাই বা বিসর্জন এবং আল্লাহর পথে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানোর মাধ্যমে তার পথে শাহাদত বরণ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এই কোরবানি মানুষের আকাঙ্ক্ষা, নিয়ত, প্রস্তুতি ও গভীরতম প্রতিশ্রুতি থেকে শুরু করে তার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন পর্যন্ত সম্প্রসারিত। মূলত কোরবানি হচ্ছে একটি প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহর জন্য বান্দার আত্মত্যাগের একটি উপমামাত্র।
কোরবানি থেকে শিক্ষা নিয়ে সারা বছরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় নিজ সম্পদ অন্যের কল্যাণে ব্যয় করার মনোভাব গড়ে উঠলে বুঝতে হবে কোরবানি স্বার্থক হয়েছে। আর না হয় এটি নামমাত্র একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠানই থেকে যাবে চিরকাল। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য কোরবানির উটগুলোকে আল্লাহর নিদর্শনের অন্যতম করেছি। যাতে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান পশুগুলোর ওপর তোমরা আল্লাহর স্মরণ (বিসমিল্লাহ বলে কোরবানি) করো। আর যখন কাত হয়ে পড়ে, তখন সেগুলো থেকে খাও। আর আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবী ও ভিক্ষাকারী অভাবগ্রস্তকে। এভাবে আমি ওদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছি; যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৬)
চিত্ত-বিত্তের মেলবন্ধনের নাম কোরবানি
কোরবানির গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। যতটুকু যায় বা রেকর্ড হয়ে থাকে, তা হলো আমাদের মনে তাঁর প্রেমের গভীরতার মাত্রা। কোরবানির গোশত গরিবদের জন্য যতটুকু সম্ভব বিলিয়ে দেওয়া চাই। কেবল সেটাই পরকালে আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে। আর যাকে আমরা আমাদের অংশ মনে করে কৃপণের ধনের মতো আঁকড়ে আছি, সেটাই বরং আমাদের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, যে বিষয়ে আমরা একেবারেই বেখবর। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, যে অর্থ তোমরা উপার্জন করেছ এবং যা কিছু আমি জমি থেকে তোমাদের জন্য ফলিয়েছি, তা থেকে উত্তম অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৭)
কাজেই আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ মানবসেবায় ব্যয় করা চাই। গরিব মানুষের সহযোগিতায় সব বিত্তশালী লোকের এগিয়ে আসা উচিত। সারা জীবন সাধ্যমতো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের কথা বিবেচনা করে মানুষকে সাহায্য করা দরকার। চিত্ত আর বিত্তের মিল ঘটানোর জন্যই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বারবার মানুষকে আহ্বান করেছেন।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক