ইসলামে ভ্রমণ বা সফর একটি উৎসাহিত বিষয়। বরং আল্লাহর সৃষ্টির বৈচিত্র্য দেখে ঈমানের দৃঢ়তা সৃষ্টি করতে এবং অবিশ্বাসীদের করুণ পরিণতি দেখে শিক্ষাগ্রহণের জন্য ভ্রমণ অন্যতম ইবাদতও বটে। এ ছাড়াও নানা প্রয়োজনে ভ্রমণ করতে হয়। মানবজীবনের সঙ্গে এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শব্দগতভাবে সব ধরনের ভ্রমণকে সফর বলা হলেও ইসলামি শরিয়তে নির্দিষ্ট দূরত্বের ও নির্ধারিত সময়ের সফরকারীকে মুসাফির বলা হয়। এমন মুসাফিরই শুধু সফরকালে ইসলামি বিধান পালনের ক্ষেত্রে ছাড় পেয়ে থাকে। যেমন—নামাজের ক্ষেত্রে কসর, রোজার ক্ষেত্রে কাজা আদায়ের সুযোগ। এ ছাড়া আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ, যা সফরকে সহজ করে।
সফর পরিচিতি
সফর আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো ভ্রমণ করা, যাত্রা বা প্রস্থান। যিনি সফর করেন তাকে বলা হয় মুসাফির। শরয়ি কসরের দূরত্ব পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি পথ অতিক্রম করার জন্য বের হওয়াকে ইসলামি পরিভাষায় সফর বলে। ইসলামের দৃষ্টিতে সফর মোট ৫ প্রকার। ১. হারাম বা নিষিদ্ধ সফর। ২. মাকরুহ বা অপছন্দনীয় সফর। ৩. মুবাহ বা জায়েজ সফর। ৪. মুস্তাহাব বা পছন্দনীয় সফর। এবং ৫. ওয়াজিব বা আবশ্যকীয় সফর। (শারহুল মুমতে আলা জাদিল মুসতাকনি, ৪/৩৪৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) গোটা জীবদ্দশায় মোট পাঁচ ধরনের সফর করেছেন। সেগুলো হলো—১. বাণিজ্য সফর, ২. হিজরতের সফর, ৩. জিহাদের সফর, ৪. ওমরার সফর এবং ৫. হজের সফর। (জাদুল মাআদ, ১/৪৪৪)
মুসাফির কে?
মুসাফির অর্থ সফরকারী বা ভ্রমণকারী। ইসলামি শরিয়তে মুসাফির এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে ৪৮ মাইল (৭৮ কিলোমিটার প্রায়) বা তার বেশি দূরত্বে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজ এলাকা ত্যাগ করে এবং গন্তব্যে পৌঁছে ১৫ দিনের কম অবস্থান করে। কাজেই যে নিজ এলাকায় অবস্থান করছে বা ৭৮ কিলোমিটারের কম দূরত্বে সফর করেছে সে মুসাফির নয়; বরং সে মুকিম। আবার ৭৮ কিলোমিটার কিংবা তার চেয়ে বেশি দূরত্বে সফর করলে পথিমধ্যে মুসাফির হলেও কোনো এক গ্রাম বা এক শহরে ১৫ দিন বা তার চেয়ে বেশি সময় অবস্থানের নিয়ত করলে ওই স্থানে সে মুকিম।
নামাজের বিধান
মুসাফির ব্যক্তি চার রাকাতবিশিষ্ট ফরজ নামাজ দুই রাকাত (কসর) পড়বেন। আর ফজর, মাগরিব ও বিতর নামাজ পুরো আদায় করবেন। সুন্নতে মুয়াক্কাদা নামাজগুলো মুকিম অবস্থার মতো আবশ্যক থাকে না। তবে সময়-সুযোগ থাকলে পড়ে নেওয়া উত্তম। সুন্নত নামাজের কসর হয় না। তাই সুন্নত আদায় করলে পুরোই আদায় করতে হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যখন জমিনে সফর করবে, তখন তোমাদের জন্য নামাজের কসর করাতে কোনো আপত্তি নেই।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১০১)
হাদিসে বলা হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জবানিতে মুসাফিরের নামাজ দুই রাকাত, মুকিম বা বাড়িতে অবস্থানকারীর নামাজ চার রাকাত এবং ভীতিকর অবস্থায় নামাজ এক রাকাত ফরজ করেছেন। (মুসলিম, হাদিস: ৬৮৭)
কসর বাধ্যতামূলক
মুসাফির ব্যক্তি সফর অবস্থায় ইচ্ছাকৃত চার রাকাত নামাজ পূর্ণ করলে আল্লাহর অনুগ্রহ উপেক্ষা করার কারণে গুনাহগার হবে। তবে মুকিম ইমামের পেছনে হলে জামাতের স্বার্থে চার রাকাত পুরো করবে। মুসা ইবনু সালামা আল হুজালি (রহ.) বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি মক্কায় অবস্থানকালে যদি ইমামের পেছনে নামাজ আদায় না করি, তা হলে কীভাবে নামাজ আদায় করব? তিনি বললেন, দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে। এটি আবুল কাসিম (সা.)-এর সুন্নত।’ (মুসলিম, হাদিস: ৬৮৮)
রোজার বিধান
মুসাফিরের জন্য সফরকালীন রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। তবে পরে কাজা আদায় করতে হবে। উত্তম হলো—যদি কষ্ট কম হয় তা হলে রোজা পালন করা। আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে রোজা পালন করে। আর কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূর্ণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর, তা চান না। এ জন্য যে, তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
কোরবানির বিধান
মুসাফিরের জন্য কোরবানিও আবশ্যক নয়। কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য মুকিম হওয়া শর্ত। কোরবানির (১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত) সময়ের মধ্যে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক, মুকিম তথা মুসাফির নয় এমন স্বাধীন মুসলমানের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। তবে মুসাফিরের জন্যও অবকাশ থাকলে কোরবানি করা উত্তম। সাওরি হাম্মাদ থেকে তিনি ইবরাহিম থেকে বর্ণনা করেন, ইবরাহিম (রহ.) বলেন, হাজি ও মুসাফিরের জন্য কোরবানির ব্যাপারে ছাড় দেওয়া হয়েছে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক, হাদিস: ৮১৪২)
পরিশেষে বলা যায়, ইসলাম ধর্ম নানাবিধ বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। এসবের অন্যতম হলো সহজসাধ্যতা। সবার জন্য উপযোগী ও উপকারী করেই ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে। এ দ্বীন অনুশীলনের মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ জীবন লাভ নিশ্চিত করা সম্ভব।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়