![বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের বিধান](uploads/2024/06/27/mass-1719478249.jpg)
মাছ শিকারের অনেক পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার পদ্ধতি বেশ পুরোনো। প্রশ্ন হলো, এভাবে মাছ ধরা শরিয়তসম্মত কিনা? অনেকে মনে করেন, বড়শি দিয়ে মাছ ধরা প্রতারণার শামিল। কিন্তু এটি প্রতারণার পর্যায়ে পড়ে না। কেননা প্রতারণার বিধান শুধু মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, মাছ বা অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রে নয়। মাছকে আল্লাহ মানুষের খাদ্য হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। ‘তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার ও তার খাদ্য হালাল করা হয়েছে, যাতে তা তোমাদের ও কাফেলার জন্য ভোগের উপকরণ হয়...।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৯৬)
আল্লাহ আরও বলেন, ‘দুটি দরিয়াও এক রকম নয়। একটি সুমিষ্ট, সুস্বাদু, সুপেয়; অন্যটি লবণাক্ত, বিস্বাদ। তথাপি তোমরা সকল (প্রকার পানি) থেকে তাজা গোশত আহার করো আর বের করো অলংকার; পরিধান করার জন্যে। তোমরা দেখতে পাও নৌযানগুলো ঢেউয়ের বুক চিরে চলাচল করে, যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ খোঁজ করতে পার, আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা ফাতির, আয়াত: ১২)। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাদেরকে যে রিজিক দান করেছি, তার মধ্যে পবিত্র বস্তুসমূহ ভক্ষণ করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৫৭)
বড়শি দিয়ে মাছ ধরার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়—
এক. মাছকে আকর্ষণ করতে বড়শিতে টোপ হিসেবে বিভিন্ন কিছু ব্যবহার করা হয়। জীবিত ছোট মাছ, ব্যাঙ, পোকামাকড় বা অন্য কোনো প্রাণী গেঁথে পানিতে রাখা হয়। জীবিত প্রাণীকে এভাবে কষ্ট দেওয়া ইসলামসম্মত নয়। হাদিসে কোনো প্রাণী বেঁধে রেখে সেটিকে তীরের লক্ষ্যস্থল বানাতে নিষেধ করা হয়েছে। আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো প্রাণী বেঁধে সেটিকে তীরের লক্ষ্যস্থল বানাতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম, হাদিস: ৪৮৯৯)
দুই. আল্লাহ সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুকে মানুষের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং মানুষ তার প্রয়োজনে মাছ শিকার করতেই পারে। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া এমনিতে বড়শির ব্যবহার করে মাছকে কষ্ট দেওয়া বা অপচয়ের সুযোগ নেই। প্রয়োজন ছাড়া শুধু বিনোদনের জন্য বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করা বৈধ নয়। কারণ এতে একদিকে নিষ্প্রয়োজনে আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দেওয়া হয়, অন্যদিকে অপচয় হয়; ইসলামে দুটোই নিষিদ্ধ। তবে মাছ শিকার করে খাওয়া বা বিক্রয় করা অথবা অন্য কোনোভাবে উপকৃত হওয়াতে সমস্যা নেই। আল্লাহ বলেন, ‘এবং আহার করবে ও পান করবে। কিন্তু অপচয় করবে না। তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৩১)
তিন. কোনো কোনো এলাকায় বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের জন্য নির্দিষ্ট মূল্যে টিকিট ছাড়া হয়। কোথাও স্থায়ীভাবে টিকিটের বিনিময়ে বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের ব্যবস্থা রয়েছে। টিকিট সংগ্রহকারীরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাছ শিকার করে থাকে। যে যা শিকার করতে পারে সেটা তার হয়ে যায়। কেউ বেশি মাছ শিকার করতে পারে, কাউকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়। মাছ শিকারের এমন পদ্ধতি শরিয়তসম্মত নয়। কারণ এতে কে কী পরিমাণ মাছ পাবে, তা অস্পষ্ট। ক্ষেত্রবিশেষে একেবারেই মাছ না পাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এটা এক ধরনের ধোঁকা ও প্রতারণা। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘পাথরের টুকরা নিক্ষেপের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় ও ধোঁকাপূর্ণ ক্রয়-বিক্রয় রাসুলুল্লাহ (সা.) নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম, হাদিস: ১৫১৩)
এ ছাড়া এতে জুয়া এবং লটারির সঙ্গেও সাদৃশ্যতা রয়েছে। কারণ এখানে সবাই টাকা দিলেও সবার মাছ পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। আবার কে কী পরিমাণ পাবে, তাও জানা নেই। মাছ না পেলে বা কম পেলে টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই। টিকিটের মূল্য থেকে বেশি মূল্যের মাছ পেলেও সমন্বয় নেই। ফলে কেউ বেশি পায়, কেউ কম পায়, আবার কেউ বঞ্চিত হয়। ইসলামে জুয়া ও লটারি হারাম। আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা, মদ, জুয়া, মূর্তি ও ভাগ্যনির্ধারক তীর ঘৃণিত শয়তানি কাজ। তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা সাফল্যমণ্ডিত হতে পার।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৯০)
তবে পুকুরে এভাবে মাছ ধরার ব্যবস্থা করা যেতে পারে যে, শিকারি যা মাছ পাবে, তা মালিকের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে ক্রয় করে নেবে। মাছ না পেলে তো আর অসুবিধা থাকল না। বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের যেমন বৈধতা রয়েছে, তেমনি এর অপব্যবহারে নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে।
মাছ আল্লাহতায়ালার দেওয়া বিশেষ এক নিয়ামত। এটা জবাই করতে হয় না, মরার পরও খাওয়া যায় এবং ইহরাম অবস্থায়ও মাছ শিকার করা জায়েজ বা বৈধ। বিভিন্ন দেশে বিভন্নভাবে মাছ শিকার করা হয়। আধুনিক যন্ত্রপাতি, দেশীয় সরঞ্জাম ব্যবহার এবং বিভিন্ন কলাকৌশল প্রয়োগ হয় এক্ষেত্রে। তবে বড়শির ব্যবহার করে মাছ শিকার করা পরিচিত ও সহজ পদ্ধতি। জীবনের সব ক্ষেত্রেই ইসলামের নির্দেশনা ও বিধান রয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো এ বিধান মানার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে এগিয়ে চলা। আমাদের উচিত, বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করার ক্ষেত্রে ইসলাম প্রদত্ত বিধান অনুসরণ করা।
লেখক: আলেম ও মাদরাসা শিক্ষক