‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের প্রতি অনুকম্পা দেখান না! তার পরও এরা (দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা) কীভাবে পদোন্নতি ও ভালো পদ পেয়ে যান! কারা এদের পদোন্নতি ও ভালো পদ দেন?’ সচিবালয়ে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের কর্মকর্তাদের নীতিনির্ধারণী সভায় গতকাল বৃহস্পতিবার এমন প্রশ্ন করেছেন একজন সচিব। তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর উদাহরণ দিয়ে অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, এসব চলতে দেওয়া যাবে না। দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। জনপ্রশাসন (মাঠ প্রশাসন) সম্পর্কে জনগণের মনে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টির জন্য শতভাগ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করার জন্যও সভায় বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র খবরের কাগজকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে বিকেলে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে সচিব কমিটির এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবসহ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব এবং সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা অংশ নেন। জানা গেছে, সভায় কৃষি, স্থানীয় সরকার, আইএমইডি, পরিকল্পনা সচিবসহ প্রায় ১৫ জন সচিব বক্তৃতা করেন। বেলা সাড়ে ৪টার দিকে শুরু হওয়া সচিব সভা শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে।
সূত্র জানিয়েছে, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ ও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেওয়ার কথা বলা হলেও এ নিয়ে সচিবদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। সভায় একাধিক সচিব বলেছেন, আয়কর আইন-২০২৩ অনুযায়ী এসব তথ্য গোপন থাকবে। তিনজন সচিব বলেন, স্ত্রীদের সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে। তবে প্রত্যেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হিসাব বিবরণী জমা দেবেন। এই তথ্য কর্তৃপক্ষকে গোপন রাখতে হবে। জনগণের কাছে প্রকাশ করা যাবে না। অন্য এক সচিব বিদেশি প্রকল্পের নামে সরকারি কর্মকর্তারা যে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ করেন, তা পুরোপুরি বন্ধ করার ব্যাপারে প্রস্তাব দেন। এর ফলে মূল্যবান সময় এবং অর্থ অপচয় রোধ করা যাবে বলে মনে করেন তিনি। সভায় প্রস্তাব দেওয়া হয়, শুদ্ধাচার পুরস্কার ফেরত নেওয়ার সুযোগ নেই। কেউ পরবর্তী সময়ে দুর্নীতিতে জড়ালে তার পুরস্কার কেড়ে নেওয়া হবে। এ জন্য নীতিমালা সংশোধন করা দরকার।
এর আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি সচিবদের নিয়ে প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির প্রথম সভা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদের সরকারের প্রথম সচিব সভা ছিল এটি। সেই সভার আলোচ্যসূচিতে ৪১টি এজেন্ডা ছিল। ওই সব বিষয়ে গতকালের সভায় আলোচনা হয়। এতে ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের সঙ্গে বিভিন্ন দপ্তর বা সংস্থায় কাজ করা সচিবরাও উপস্থিত ছিলেন।
বর্তমানে নিয়মিত ও চুক্তিভিত্তিক মিলিয়ে ৮৫ জন সচিব ও সিনিয়র সচিব দায়িত্ব পালন করছেন। সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে সিনিয়র কয়েকজন সচিব বলেন, ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯-এ সংশোধনে জনমতের প্রতিফলন থাকা উচিত। এ জন্য বিদ্যমান আইন অনুযায়ী প্রত্যেককে সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে। প্রয়োজনীয় জনবলও নিয়োগ করতে হবে। কারণ বিদ্যমান জনবল দিয়ে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর সম্পদের হিসাব যাচাই-বাছাই করা অসম্ভব।’
সভায় সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ ও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল নিয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা হয়েছে। তবে সম্পদের হিসাব জমা দেওয়া না দেওয়ার বিষয়টিই বেশি সময় ধরে আলোচনা হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে জনগণের মাঝে নানা আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হওয়ায় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে দুর্নীতি দমনে বিশেষ জোর দিতে বলা হয়। কয়েকজন সচিব বলেন, ‘গুটিকয়েক জনের কারণে প্রশাসনের সবার ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তারা বলেন, নিজ নিজ দপ্তর ও অধীন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সম্পর্কে সব সময় সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
একজন সিনিয়র সচিব বলেন, শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রাপ্ত কারও কারও নামে পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ আসছে। এ সময় আলোচনা হয়, তারা প্রত্যেকেই সম্পদের হিসাব জমা দেন। এনবিআর-এ প্রত্যেকের আয়কর নথি আছে। চাকরিতে প্রবেশের সময় সম্পদের হিসাব নেওয়া হয়। এ ছাড়া সরকারি কর্মচারী আচরণবিধিমালায়ও ৫ বছর পর পর সম্পদের হিসাব কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার বিধান আছে। কেউ কেউ বলেন, সম্পদের বিবরণী সরাসরি কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়ার বিধান থাকা উচিত। এ জন্য বিধিমালা সংশোধন করে বিষয়টি সহজ করা দরকার।
বৈঠকে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান ও কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেছেন, দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। কেউ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হলে তাকে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না। কারণ প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। এ ছাড়া তারা বলেন, সম্পদের হিসাব দেওয়া যাবে। তবে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গোপন রাখতে হবে।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি পাঁচ বছর পরপর সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের স্বল্পমেয়াদি সুপারিশ ছিল প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে জনপ্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ কর্তৃক এ ক্ষেত্রে আগে ভেটিংকৃত অংশ হতে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা উপবিধি-১০(২) বাদ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আয়কর আইন, ২০২৩-এ ৩০৯ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ ওই উপবিধি-১০(২) বাদ দেয়। একইভাবে ১১ ধারার বিষয়ে মতামত দিয়েছে লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ। এ নিয়েও বৈঠকে সচিবদের মধ্যে মতানৈক্য হয়।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণবিধিমালা দ্রুত যুগোপযোগী করে নতুন বিধিমালা চূড়ান্ত করা হবে। একই সঙ্গে ২০১২ সালের শুদ্ধাচার কৌশল সংশোধন করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যখন প্রথম সচিব সভা করেন তখন আমাদের কাছে একটি নির্দেশনা এসেছিল, আমরা যেন বছরে অন্তত দুটি সচিব সভা করি। আমরা হিসাব করেছিলাম যে, জুলাই মাসে আমরা একটি সচিব সভা করব। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। প্রথম সভার যে বাস্তবায়ন অগ্রগতি সেটি জানতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে চিঠি দিয়েছিলাম। সেটির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আজকের মিটিং করেছি।’
সভায় গত সভার বাস্তবায়ন অগ্রগতি আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা শুদ্ধাচার বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছি। বাজেট বাস্তবায়ন এবং নির্বাচনি ইশতেহার নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের কিছু দাপ্তরিক কাজে প্রধানমন্ত্রী সময়ে সময়ে যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন, সেগুলো যেন যত্নসহকারে সিরিয়াসলি অনুসরণ করা হয়, সে ব্যাপারে সভায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সচিব বলেন, সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের সেবা দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনা ছিল। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হওয়ায় তাদের মধ্যে বিব্রতকর অবস্থা বিরাজ করছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন তারা। তারা বলেন, আজকের (গতকালের) সচিব সভায় নির্ধারিত কিছু এজেন্ডা থাকলেও অনির্ধারিত সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা সংশোধন এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনাসংবলিত মাঠ প্রশাসনের প্রত্যেক কর্মকর্তার কাছে চিঠি পাঠানো হবে।
‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯’ অনুযায়ী পাঁচ বছর পরপর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী দাখিল এবং স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির অনুমতি নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সরকার বিধিমালাটি বাস্তবায়ন করছে না। পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমানসহ সরকারের অনেক কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও সরকারি দপ্তরে কোনো তথ্য নেই। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর বিষয়টি এবার আলোচনায় এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত এ বিধিমালাটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সচিব সভায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সচিবদের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দুর্নীতি প্রতিরোধ, সরকারি অর্থের সাশ্রয় ও রপ্তানি বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলোও বিশেষ গুরুত্ব পায় সভায়।