![নৌ-পুলিশের অঞ্চল আছে, ইউনিট নেই](uploads/2024/07/05/Syleth-1720170152.jpg)
সিলেটের পিয়াইন নদ ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি চ্যুতিস্থলের সঙ্গে যুক্ত। সীমান্তের ডাউকি-জাফলং হয়ে বেশ কয়েকটি উপজেলার নদ-নদীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে প্রবাহিত। গত ৩০ জুন ভোরের দিকে পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের ছৈলাখেল এলাকার পিয়াইন নদের উত্তর পাড়ে ভারতীয় চোরাই চিনি নৌপথে পারাপার চলছিল। কিন্তু সে সময় মামারবাজার পয়েন্টে অবস্থান করছিল একদল পুলিশ। বেলা সাড়ে ৩টায় তারা অভিযান চালায়। কিন্তু সময়ক্ষেপণের ফলে টের পেয়ে পালায় চোরাচালানিরা। একজন চোরাকারবারি আটকসহ ইঞ্জিনচালিত স্টিল বডির নৌকার মধ্য থেকে ভারতীয় ৫০ কেজি ওজনের ১১৫ বস্তা চোরাই চিনি জব্দ করে পুলিশ।
জাফলংয়ে থানা-পুলিশ ও পাশাপাশি তৎপর পর্যটন পুলিশ। নৌপথে থাকার কথা নৌ-পুলিশের। কিন্তু সেখানে নেই কোনো ফাঁড়ি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ‘সিলেট অঞ্চল’ নামে নৌ-পুলিশের একটি আঞ্চলিক দপ্তর থাকলেও সিলেটের নৌপথ সুবিধার উপজেলাগুলোতে নেই কোনো ইউনিট।
বন্যার সময় সিলেট অঞ্চলের নৌপথগুলো সচল হওয়ায় সীমান্তবর্তী জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলার রুটগুলোতে নৌপথে চিনি, ওষুধ, কসমেটিকসসহ নানা ভারতীয় পণ্য অবৈধভাবে আনা হয়। বর্ষাকালে নদীগুলোতে ভারতের পাহাড়ি ঢলে পানি বাড়ার ফলে সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোতে নৌপথে চোরাচালান বাড়ে। নৌ-পুলিশের কোনো ইউনিট না থাকায় নিশ্চিন্তেই চোরাচালান করে চোরাকারবারিরা।
সরেজমিনে জানা যায়, বিভিন্ন সময় বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সাঁড়াশি অভিযান চালান। কিন্তু নৌপথে নজরদারি থাকলেও চোরাকারবারিদের ঠেকানোর জন্য পর্যাপ্ত জলযান বা আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি না থাকায় তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করতে পারে না নৌ-পুলিশ। তাই নৌপথ পাড়ি দিয়ে যখনই সড়কপথে চোরাই পণ্য পরিবহন করা হয়, তখন সেগুলো জব্দ করে পুলিশ।
আঞ্চলিক দপ্তর সূত্রে জানা যায়, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় নৌ-পুলিশের ইউনিট নেই। সুনামগঞ্জে পাঁচটি ফাঁড়ি এবং হবিগঞ্জে তিনটি ফাঁড়ি রয়েছে। এই আটটি ফাঁড়ির মধ্যে জলযান আছে মাত্র চারটিতে; মোট জনবল ৯৯ জন। একেকটি ফাঁড়িতে ৮ থেকে ১০ জন নৌ-পুলিশ সদস্য রয়েছেন। এর মধ্য থেকে ছুটি, অসুস্থতা, ট্রেনিং থাকায় গরহাজির থাকে। যারা কর্মরত থাকেন, তাদের নিয়েই বিভিন্ন অভিযান ও টহল পরিচালনা করা হয়।
নৌপথে চাঁদাবাজির ৩৯ পয়েন্ট
নদীপথে পণ্যবোঝাই জলযান চলার জন্য নদীর অগভীর জায়গা চিহ্নিত করে দিতে বাঁশের মাথায় লাল কাপড় বেঁধে নদী চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। এটাকে স্থানীয়ভাবে ‘মার্কার’ বলে। প্রায় ১৫ বছর ধরে স্থানীয়রা নৌযানকে সহযোগিতা করতে এভাবে নদীতে মার্কার দিয়ে আসছেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এই মার্কার-চিহ্নিত স্থানে চাঁদাবাজি চলছে। নৌ-পুলিশের ছাতক ফাঁড়ি চেঙ্গেরখাল ছাড়া সিলেটের আর কোনো নদীতে টহল দিতে পারে না। এই নদীপথ ছাড়া সুনামগঞ্জ দিয়ে প্রবহমান সুরমা নদীসহ শাখা-উপশাখা মিলিয়ে অন্তত শতাধিক পয়েন্টে মার্কার রয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি পয়েন্টে চলছে চাঁদাবাজি। এসব চাঁদাবাজির মূল উদ্দেশ্য চোরাকারবারিদের পণ্য নিরাপদে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া।
নৌ-ইজারাদারদের চাঁদাবাজি
সিলেটের নদীগুলোর বিভিন্ন অংশে জেলা-উপজেলা প্রশাসন, পৌরসভা, ইউনিয়ন থেকে ইজারা দেওয়া হয়। এসব ইজারাদার নির্দিষ্ট শর্ত মেনে ইজারা নিলেও বেশির ভাগ সময় নির্দিষ্ট টোলের বাইরেও অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন। পণ্য পরিবহনকারী নৌযান শ্রমিকদের অভিযোগ, নির্ধারিত মূল্যের বাইরে ১ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবি করেন ইজারাদাররা।
কোথাও কোথাও বিআইডব্লিউটিএর ইজারা, আবার কোথাও স্থানীয় প্রশাসনের কালেকশন আদায়ের নামে এই জুলুম চলছে। ইজারার শর্ত না মেনে যার যত ইচ্ছা টাকা আদায় করায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাল্কহেড মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন বলেন, ‘নৌ-পুলিশ এখন আরেক যন্ত্রণার নাম। বাল্কহেড বা যেকোনো ইঞ্জিনচালিত নৌযানের কাগজ দেখেন তারা। কাগজপত্র ঠিক থাকলেও টাকা দিতে হচ্ছে।’
এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে নৌ-পুলিশ সিলেট অঞ্চলের পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল-মামুন লোকবল কম ও ফাঁড়ির সংখ্যা অপ্রতুল থাকায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বিলম্বিত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের নৌ-পুলিশের সব জায়গায় ইউনিট নেই; যেখানে যেখানে আছে, সেখানে আমরা নৌ-টহল করি। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করি। গত দুই মাসে আমরা দুই দফা চোরাই চিনির চালান এবং অবৈধ মাদক ও কসমেটিকস ধরেছি। আমরা যখনই আমাদের নৌ-টহলে ও রাতে সংবাদ পাই, তখন আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিজেদের অবস্থা গুছিয়ে কনফার্ম হয়ে এরপর অভিযানে যাই। কারণ আমাদের জনবলের স্বল্পতা রয়েছে।’
পুলিশ সুপার বলেন, ‘একটি জেলা থানায় যেখানে ৬০ থেকে ৭০ জন কাজ করেন, সেখানে আমরা স্বল্প জনবল নিয়ে দুর্গম এলাকায় কাজ চালাচ্ছি। সারা বাংলাদেশেই নৌ-পুলিশের জনবল কম। যেহেতু গোটা দেশে এই সমস্যা, তাই অনেক জায়গায় প্রয়োজন হলেও আমাদের ইউনিট নেই। অবশ্য নৌপথ নিরাপদ রাখতে জনবল বাড়াতে প্রস্তাব দেওয়া আছে।’
চোরাচালান ছাড়া নৌপথে ‘মার্কার’ দিয়ে ৩৯ পয়েন্টে চাঁদাবাজির ব্যাপারে নৌ-পুলিশ সুপার বলেন, ‘বর্ষাকালে মালামাল নিয়ে ডুবোচরে নৌযান আটকা পড়লে সহযোগিতার জন্য বাঁশের মধ্যে লাল কাপড় বেঁধে মার্কার দেওয়া হয়। কিন্তু আমার নৌ-পুলিশ থেকে বলেছি, এটাও করা যাবে না। এই মার্কারের খবর পেলেই আমরা অভিযান চালাই। নৌযানগুলোকে সহযোগিতার নাম করে টাকা নিতে চাইলেই অভিযান করে আমরা চাঁদাবাজদের ধরি।’
নিরাপদ নৌপথ দাবি
বর্ষাকালে নৌপথ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ থাকে না সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, মধ্যনগর ও ধরমপাশা উপজেলার। এই পাঁচটি উপজেলার মধ্যে চারটি পড়েছে সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনি এলাকায়। সেখানে একটানা ১৫ বছর সংসদ সদস্য ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। তিনি গত ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে হেরে যান। সুনামগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের নতুন সংসদ সদস্য হয়েছেন অ্যাডভোকেট রণজিত সরকার। বহুদিন ধরেই এ অঞ্চলের নিরাপদ নৌপথের দাবি জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। এলাকায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে একটি চক্র ইজারার নামে চাঁদা আদায়ে সক্রিয় বলে মনে করছে শ্রমিক সংগঠন।
রণজিত সরকার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার নির্বাচনি এলাকা চারটি উপজেলা নিয়ে গঠিত। এখানে অনেক হাওর আছে। একটানা ১৫ বছর এখানে একধরনের লুটপাটের রাজত্ব ছিল। আমি এখানকার সংসদ সদস্য মাত্র পাঁচ মাস। এই কদিনে অনেক কিছু সামাল দিয়েছি ও দিচ্ছি। লুটপাট-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আমি সব সময় সোচ্চার থাকব। কেবল নৌপথ নয়, সব পথ নিরাপদ রাখতে প্রশাসনকে নিয়ে বন্যা পরিস্থিতির পরই আলোচনায় বসব।’