চট্টগ্রাম অঞ্চলে সরকারি খাদ্য পরিবহনে দরপত্র ছাড়াই কাজ পেতেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ঠিকাদাররা। বিগত সরকারের আমলে আট বছর ধরে চলেছে এই অনিয়ম। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র না হওয়ায় সরকার একদিকে যেমন রাজস্ব হারিয়েছে, অন্যদিকে খাদ্য পরিবহনে গড়ে ওঠা ঠিকাদার সিন্ডিকেট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত ৫ কোটি টাকা। সিন্ডিকেটের গোড়ায় রয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরের মাফিয়া ও যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মাহমুদুল হক।
একাধিক ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেছেন, মামলার ফাঁদে ফেলে সিন্ডিকেটটি লুটেপুটে খেয়েছে। মামলার কারণে দরপত্র আহবান করা যায়নি এ কথা সত্য। কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তর থেকে জোরালোভাবে মামলা মোকাবিলা করতে চরম অনীহা রয়েছে। যদিও ঠিকাদারি অব্যাহত রাখতে প্রতি তিন মাস অন্তর আঞ্চলিক খাদ্য অধিদপ্তর থেকে দরপত্র রিনিউ করে নিয়েছে। এই কাজের ‘খরচ’-এর জন্য প্রতি সদস্যকে প্রতি তিন মাস অন্তর তিন হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়েছে। শুধু অফিস খরচের জন্য সিন্ডিকেটটি ১০ বছরে চাঁদাবাজি করেছে পাঁচ কোটি টাকা।
তারা জানান, ২০১২ সালে দরপত্রের মাধ্যমে দুই বছরের জন্য খাদ্য পরিবহনের কাজ দেয় অধিদপ্তর। ওই সময় ঠিকাদার ছিলেন ৪১০ জন। সেই সময় অফিস ম্যানেজের জন্য সদস্যদের কাছ থেকে এককালীন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে আদায় করে কমিটি। যার পরিমাণ প্রায় কোটি টাকা। এরপর ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দরপত্র ছাড়াই পরিবহন কাজ করেন ঠিকাদাররা। এই চার বছরও প্রতি তিন মাস অন্তর তিন হাজার টাকা করে চার বছরে প্রায় দুই কোটি টাকা আদায় করা হয়। ২০১৮ সালে দরপত্র আহ্বান করে ২০২০ সাল পর্যন্ত নিয়মমতো খাদ্য পরিবহন করলেও ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সেই পুরোনো কায়দায় দরপত্রবিহীন কাজ করছেন ঠিকাদাররা। ২০১৮ সালে ঠিকাদারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪৬৮ জন। তাদের কাছ থেকে প্রতি তিন মাসে আদায় করা হয় ১৪ লাখ ৪ হাজার টাকা। বছরে আদায় করা হয় ৫৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা। সে হিসাবে সর্বশেষ ৪ বছরে চাঁদাবাজি করেছে ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। সিন্ডিকেটটি গত এক যুগে শুধু ঠিকাদারদের কাছ থেকেই হাতিয়ে নিয়েছে ৫ কোটি টাকা।
সাধারণ ঠিকাদারদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ মাহমুদুল হক ১৪ বছর আগে প্রভাব খাটিয়ে খাদ্য অধিদপ্তর চট্টগ্রামের ঠিকাদার সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রতি দুই বছর অন্তর সমিতির নির্বাচন হওয়ার নিয়ম থাকলেও ২০২৪ পর্যন্ত সেখানে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। প্রতিবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এভাবে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অফিস নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি। ২০১৮ সালের পর থেকে চট্টগ্রামে আর নতুন করে কোনো ঠিকাদারও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি।
ভুক্তভোগী ঠিকাদার মোহাম্মদ টিটু খবরের কাগজকে বলেন, ‘একটি পক্ষের একচ্ছত্র আধিপত্য ভাঙতেই তারা নির্বাচন করেছেন। প্রতি তিন মাস অন্তর দরপত্র রিনিউ করতে কত টাকা খরচ করতে হয় তা তারা জানেন না। অথচ প্রতি সদস্যের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা করে আদায় করা হয়েছে। নির্বাহী কমিটিতে উভয় পক্ষের নেতৃত্ব থাকলে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ বেশি থাকে। আমরা সেটাই চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা চায় না সংগঠনে স্বচ্ছতা আসুক।’
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি হয়ে মাহমুদুল হক আত্মগোপনে। তার অবর্তমানে নির্বাচন ও ব্যবসা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ। মাসুদের নামে বেনামে একাধিক ঠিকাদারি লাইসেন্স রয়েছে। গত ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সমিতির নির্বাচনি প্রচার, মনোনয়ন ফরম জমাদান কিছুতেই ছিলেন না মাহমুদুল হক। প্রতিপক্ষরা বলছেন তার বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলা থাকায় তিনি পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। একজন পলাতক ব্যক্তি কীভাবে নির্বাচন করেছেন? তার স্বাক্ষর কে দিয়েছেন? নিশ্চয় জালিয়াতি হয়েছে।
আরেক ঠিকাদার ও নির্বাচনে সভাপতি প্রার্থী এস এম আবুল মনসুর খবরের কাগজকে বলেন, মাহমুদুল হকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট যে চাঁদা আদায় করেছে, তার ভাগ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পাননি। তার কাছে কেউ ভয়ে টাকা দাবি করতে পারতেন না। অথচ সদস্যদের কাছ থেকে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়েছে।
মাহমুদুল হকের ঘনিষ্ঠ ও ব্যবসায়ী অংশীদার আবদুর রাজ্জাক খবরের কাগজকে বলেন, মাহমুদুল হক আওয়ামী লীগ নেতা হলেও তিনি সেই প্রভাব চট্টগ্রামের সাধারণ ঠিকাদারদের মাঝে খাটাননি। বরং তিনি সবাইকে শান্তিতে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি যতদিন ধরে ঠিকাদারদের সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ততদিন ধরে সব ঠিকাদার লাভবান হয়েছেন। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ঠিকাদার স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেকোনো কিছু তিনি সহজেই আদায় করতে পারেন। তাই তিনি জনপ্রিয়। এ কারণে কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই তিনি ভোটে এগিয়ে আছেন বলে তারা শুনেছেন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এস এম কায়ছার আলী খবরের কাগজকে বলেন, মামলার কারণে তারা খাদ্য পরিবহনে দরপত্র আহবান করতে পারছেন না। একটি মামলা হয়েছে নারায়ণগঞ্জে, অপরটি ঢাকায়। যে কারণে বাধ্য হয়ে প্রতি তিন মাস অন্তর দরপত্র রিনিউ করে দিচ্ছেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের মামলা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে দুটি গ্রুপ তদবির করছে। আদালতের সিদ্ধান্ত পেলে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা যাবে। তাতে সরকার রাজস্ব পাবে। দরপত্র রিনিউর সময় অবৈধ লেনদেনের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
তথ্যমতে, দেশে সরকারিভাবে আমদানি করা খাদ্যশস্যের বেশির ভাগই আসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এ ছাড়া দেশের কৃষক ও চালকল মালিকদের কাছ থেকেও ক্রয়কৃত খাদ্যশস্য সংরক্ষণে চট্টগ্রামের হালিশহর ও দেওয়ানহাটে রয়েছে খাদ্যগুদাম। গম মজুতে পতেঙ্গায় রয়েছে সাইলো। পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর রেশনের চাল, গম এবং সরকারি খাদ্যবান্ধব প্রকল্পের খাদ্য চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার বিভিন্ন খাদ্যগুদামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসব ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়।