![তেরো বছরে ১৩ লাখ!](uploads/2023/11/24/1700808139.---b-jab-13.jpg)
শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখতে রাখতেই অনেকেই এমন কিছু করে ফেলে, যার জন্য গোটা পৃথিবী তাদের মনে রাখে। তেমনই এক কিশোরী এলিয়ান ক্লিস্টান ওয়ানজিকু। কী করেছে সে? জানাচ্ছেন জাজাফী।
কেনিয়ার নাইরোবির হিলভিউ স্টেটের চারপাশে সে সাইকেল চালাতে ভালোবাসে। পৃথিবীকে সবুজে ভরে দিতে চায় সে। হতে চায় ওয়েনগেরি মাথাইয়ের যোগ্য উত্তরসূরি। যদিও এরই মধ্যে ওয়েনগেরি মাথাইয়ের উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে পেরেছে সে। ও হলো ওয়ানজিকু। এখন ওর বয়স ১৩ বছর। জন্ম ও বেড়ে ওঠা কেনিয়ায়।
৮ বছর বয়সেই সে কেনিয়া সরকারের ‘ইকো ওয়ারিয়র’ পুরস্কার পেয়ে কেনিয়ার সর্বকনিষ্ঠ মাশুজা বা জাতীয় হিরো হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মাত্র ৪ বছর বয়স থেকে গাছ লাগানো শুরু করে ১৩ বছর বয়সে তার লাগানো গাছের সংখ্যা ১৩ লাখ!
২০২১ সালে মাত্র দশ বছর বয়সে সে পল হ্যারিস ফেলোশিপ পুরস্কারে ভূষিত হয়। বৃক্ষরোপণ এবং প্লাস্টিক দূষণ বন্ধের জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে সে। সে মনে করে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৭০% মানুষ শহরে বাস করবে। সুতরাং যদি আমরা সুস্থ সুন্দর জীবনযাপন করতে চাই তবে অবশ্যই আমাদের শহরগুলোকে সবুজ ও স্বাস্থ্যকর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
মাত্র চার বছর বয়সে কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সময় ওয়ানজিকুদেরকে একটি প্রজেক্ট করতে দেওয়া হয়েছিল হিরোদের উপর। সেই প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সে প্রথম জানতে পারে আফ্রিকার প্রথম নারী নোবেল বিজয়ী এবং কেনিয়ার পরিবেশবাদী বিশ্ববিখ্যাত নারী ওয়েনগেরি মাথাই সম্পর্কে।
ওয়েনগেরির কাজ সম্পর্কে জেনে তার ছোট্ট মনে মাথাইয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। এবং তাকে আইডল মেনে তার মতো হতে চেয়েছিল। এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। একদিন মায়ের সঙ্গে কয়েকটি চারা কিনে বাড়িতে নিয়ে লাগাল।
![](http://www.khaborerkagoj.com/public/image/2023/24/YEAR-13.jpg)
সেই থেকে তার মধ্যে বৃক্ষরোপণের প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা বেড়ে গেল। কাছাকাছি থাকা স্কুলগুলোতে গাছ লাগাতে শুরু করল। এবং এটা তার কাছে খুবই আনন্দের বিষয় হয়ে উঠল। তার মনে হতো গাছেরা যেন তার সঙ্গে চুপিচুপি কথা বলছে।
কয়েক বছর পর এলিয়ান তরুণদের সঙ্গে নিয়ে মায়ের সহযোগিতায় একটি সংগঠন দাঁড় করাল- ‘চিলড্রেন্স উইথ নেচার’। প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ ছিল তার মতো সবুজ পৃথিবী চাওয়া কিশোর-কিশোরীদের সংগঠিত করা। তাদের এই কার্যক্রম সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গল বা এসডিজির পাশাপাশি কেনিয়ার ভিশন ২০৩০ এর সঙ্গে যুক্ত হলো।
এলিয়ান তার দলবল নিয়ে স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের বোঝাতে লাগল কেন গাছ লাগানো প্রয়োজন এবং কিভাবে প্লাস্টিক আমাদের পরিবেশকে নষ্ট করছে। কিভাবে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
সে ও তার দল ৭৯টি স্কুলে গিয়ে রোপণ করার জন্য গাছের বীজ বিতরণ করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন হোটেল ও পার্কেও তারা বীজ উপহার দিয়েছে শুধুমাত্র পরিবেশগত পরিবর্তন আনার জন্য।কিন্তু এত বীজ এবং চারা কেনার জন্য প্রয়োজন হয়েছে অনেক টাকা। সে শুরু করেছিল নিজের টিফিনের টাকা ও জমানো টাকা দিয়ে।
পরবর্তীতে তার এই কাজ দেখে অনেকেই টাকা, বীজ ও চারা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এলিয়ান তার সংগঠনের মাধ্যমে পুরো আফ্রিকাকে সবুজায়নের পাশাপাশি আমেরিকাতেও কার্যক্রম বেগবান করেছে।
৪ বছর বয়সে যে শিশুটি গাছ লাগানো শুরু করেছিল তার বয়স এখন ১৩। সে এখন কিশোরী। এই নয় বছরে সে তার সংগঠনের মাধ্যমে ১৩ লাখ গাছ লাগিয়েছে।
এখন তার লক্ষ্য সাহেল মরুভূমির বুকে ৮ হাজার কিলোমিটারজুড়ে বনায়ন করার। এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ মিলিয়ন অবক্ষয়িত জমি পুনরুদ্ধার করা এবং ২৫০ মিলিয়ন টন কার্বন রিসাইক্লিং করা। একই সঙ্গে প্রচুর বাঁশ লাগানো যাতে নদী পরিষ্কার করা যাবে এবং সেগুলো বিক্রি করে তার কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারবে এবং প্রচুর বাবলা গাছ লাগাতে চায় যেটা পর্যাপ্ত ছায়া দিবে। আর এই বছরে সে সাহিল মরুভূমিতে ১ মিলিয়ন গাছ লাগানোর টার্গেট নিয়েছে।
সম্প্রতি কেনিয়ার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কেবিনেট সেক্রেটারি কেরিয়াকো টোবিকো তাকে ‘মিচুকি পার্ক আরবান গ্রিন স্পেস’ প্রকল্পের কো-চেয়ার নির্বাচন করেছে।
যেদিন এই পার্ক উদ্বোধন করা হয়েছিল সেদিন এলিয়ান কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু মুইগাই কেনিয়াত্তাকে পার্কের সব দিকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। প্রজেক্টে এলিয়ানের দায়িত্ব হলো সবুজায়ন ঠিক রেখে শিশুদের খেলার সুযোগ তৈরি করা এবং খেলতে খেলতে শেখার ব্যবস্থা করা।
একবার তার স্কুলের পাশের সবচেয়ে বড় গাছটি কেটে ফেলা হয়েছিল। এই গাছের সঙ্গে তার ছিল অনেক স্মৃতি। ওই গাছের ছায়ায় বসে বন্ধুরা মিলে বই পড়ত, গল্প করত। গাছটি কেটে ফেলায় তার হৃদয়ে আঘাত লেগেছিল।
![](http://www.khaborerkagoj.com/public/image/2023/24/dulbol-jabe.jpg)
সেই বয়সেই সে জেনেছিল স্কুলের জন্য ভবন নির্মাণের মতো যথেষ্ট জায়গার জন্য গাছটি কাটা হয়েছে। তবে গাছ কাটলেও পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য প্রচুর গাছ লাগানো দরকার।
অনেক সময় অনেক স্কুলে গিয়ে কটূকথাও শুনতে হয়েছে তাকে। তবু সে দমে যায়নি। তার মতে শুধু সুন্দর সুন্দর রাস্তা, উঁচু উঁচু ভবন, দামি দামি গাড়ি থাকাটাই উন্নয়ন নয়। পাশাপাশি বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও অপুষ্টিতে ভুগে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে হবে।
বৃক্ষনিধনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়ত আজ দেখা যাচ্ছে না; কিন্তু এর ভয়াবহ রূপ আরও অনেক বছর পর উপলব্ধি করা যাবে যখন প্রতিহত করার সুযোগ থাকবে না। তাই এখন থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি।
তবে এমনভাবে গাছ লাগানো উচিত যেন ইকোসিস্টেমে কোনো বাধা তৈরি না হয়। এলিয়ান তার বয়সী বন্ধুদের বলেছে, তুমি কিছু খাওয়ার পর যদি বীজ পাও, বীজটি মাটিতে পুঁতে দাও। যেন তা থেকে চারা জন্মাতে পারে। পরিবর্তন আনতে হলে তুমি যতটুকু পারো সেটাই শুরু করো। শুরুতেই বিরাট কিছু করতে না পেরে হতাশ হওয়া যাবে না।
সম্প্রতি এলিয়ান বিখ্যাত ফুটবলার ডেভিড ব্যাকহামের সঙ্গে কলেরা নির্মূল বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে যুক্ত হয়েছে। এলিয়ান কেনিয়ার সর্বকনিষ্ঠ পরিবেশবিদ হিসেবে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। সম্প্রতি বিশ্ব বিখ্যাত ব্লগার ‘নাস ডেইলি’ তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আর এ পর্যন্ত তিনটি বই লিখেছে এলিয়ান।
কলি