![সাইকেল যার ধ্যান-জ্ঞান](uploads/2024/05/31/a-1717140880.jpg)
তাম্মাত বিল খয়ের। সাইকেল নিয়ে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। এর মধ্যেই সাইকেল নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন হাজার হাজার মাইল পথ।
তাম্মাতের জন্ম চট্টগ্রামে। বাবা চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনস মসজিদের ইমাম, মা গৃহিণী। সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট তাম্মাত। বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনসে। পড়াশোনা করছেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তাম্মাত প্রথমে সাইকেল চালানো শেখেন ভাইয়ের কাছে। বাবা-মা চাইতেন না তাম্মাত সাইকেল চালানো শিখুক। কারণ পুলিশ লাইনসের পাশেই রয়েছে মেইন রোড। সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তাম্মাতকে সাইকেল কিনে দিতে চাননি বাবা-মা। ছোটবেলায় তাম্মাত বিটিভিতে দেখতে পান একজন লোক সাইকেল চালিয়ে পুরো বাংলাদেশ ঘুরছেন। এটা তাকে দারুণ অনুপ্রাণিত করে। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন একদিন বড় হয়ে সাইকেলে বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ছোটবেলা থেকেই গণিতে ভালো ছিলেন। অষ্টম শেণিতে পড়ার সময়ই সহপাঠীদের পড়িয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। সেই টাকা দিয়ে কলেজে পড়ার সময় একটি সাইকেল কেনেন। এরপর একদিন সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। সেটা তার জীবনের অন্যতম খারাপ একটি দিন ছিল। সাইকেল হারানোর কষ্টে সেই রাতে বেশ কান্নাকাটি করেছিলেন তাম্মাত।
![](../../../image/2024/%E0%A6%AE%E0%A7%87%20%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B8/%E0%A6%AE%E0%A7%87%20%E0%A7%A9%E0%A7%A7/a1.jpg)
কলেজজীবন শেষে আরেকটি সাইকেল কেনেন। ঢাকা থেকে লুকিয়ে সাইকেলটা কিনে আনেন। ২০১৬ সালে কমিউনিটি সাইকেলের সঙ্গে যুক্ত হন। চট্টগ্রামের সাইকিলিং গ্রুপগুলো চট্টগ্রামে রাইড দেয়। তাদের সঙ্গে থেকে নানা বিষয় শেখেন। আর তখন থেকেই বুঝতে পারেন, এমনি সাইকেল চালানো আর সাইকেল নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য সাইকেল চালানো আলাদা বিষয়।
কমিউনিটির সবাই ততদিনে জেনে যায় যে, তাম্মাতের লক্ষ্য সাইকেলে ঘুরবেন সারা বাংলাদেশ। এরপর গ্রুপের নোমান ও বাবুলের সঙ্গে পরিচয় হয় তাম্মাতের। যারা কয়েক বছর আগেই সারা বাংলাদেশ ঘুরেছেন ২৯ দিনে। নোমান ভাইয়ের কাছ থেকে নানা ধরনের পরামর্শ নেন। এরপর এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা পাড়ি দেওয়ার জন্য বের হন। যদিও পরিবারকে জানান যে, সঙ্গে আরও ২০-২৫ জন আছে। মিথ্যা ধরা পড়ার ভয়ে এক রাতে সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। সে রাত তাম্মাতের জীবনের অন্যতম আনন্দ ও আতঙ্কের রাত।
পরিবার ছাড়া চট্টগ্রাম শহরের বাইরে কখনো না যাওয়ার করণে তাম্মাত বেশ ভয় পেতে থাকেন। এরপর চট্টগ্রাম শহর পার হওয়ার পর দুর্ঘটনায় পড়েন। তখনই মত বদলে বাড়ির পথ ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন পূরণের পথেই এগোলেন। সেই রাতকে তাম্মাত তার জীবন পাল্টনো রাত বলেন।
![](../../../image/2024/%E0%A6%AE%E0%A7%87%20%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B8/%E0%A6%AE%E0%A7%87%20%E0%A7%A9%E0%A7%A7/a2.jpg)
ঝুঁকি এড়াতে তাম্মাত সঙ্গে রাখতেন সাইকেলের সাধারণ সমস্যা ঠিক করার যন্ত্রপাতি এবং দুই সেট কাপড়। শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম দিয়ে। ধীরে ধীরে ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা যান। মাত্র ২৫ দিনে ৬৪ জেলা ঘোরা শেষ করেন।
এই যাত্রা শেষ করার পর সব ভয় কেটে যায় তার। ভ্রমণের বিষয়ে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ২০১৭ সালের পর সিদ্ধান্ত নেন প্রতি বছর কোনো না কোনো অ্যাডভেঞ্চার করবেন।
এলাকার বড় ভাইদের সঙ্গে বান্দরবান যেতেন সাইকেল নিয়ে। তাঁবু গেড়ে থাকতেন এবং নিজেরাই রান্না করে খেতেন। চার-পাঁচ দিন তাদের সঙ্গে পাহাড়ে হাঁটতেন এবং বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। পাহাড় থেকে মজার আম খেয়ে ২০ কেজি ব্যাগে করে নিয়েও আসেন দুই দিন পাহাড়ে ট্র্যাকিং করে। এরপর কমিউনিটির সবাই পাগল বলতে থাকে তাম্মাতকে।
চট্টগ্রামের এক স্থানীয় ম্যারাথনে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হন। এরপর সিদ্ধান্ত নেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ১ হাজার কিলোমিটার হাঁটবেন। ২০১৮ সালে হেঁটে পাড়ি দেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ফোসকা পড়ে যায়। ডাক্তারের বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শও কানে তোলেননি। আবারও শুরু করেন হাঁটা। তাম্মাতের এই গল্প ছড়িয়ে পড়লে তেঁতুলিয়া থেকে বাংলাবান্ধা তার সঙ্গে হাঁটেন অনেক তরুণ; যা তাকে ভীষণভাবে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। পাশাপাশি নানা ম্যারাথনে অংশ নিতেন। বন্ধুদের থেকে টাকা ধার করে নানা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন এবং প্রথম থেকে তৃতীয় হতেন, সেখান থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে ধার শোধ করতেন। একবার তো এক বন্ধুর হানিমুনের টাকা নিয়ে এক প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।
ভারত, নেপালসহ কয়েকটি দেশের ম্যারাথনেও অংশ নেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আয়োজনে বগা থেকে কেওক্রাডংয়ের ম্যারাথনে অংশ নিয়ে টানা দুবার চ্যাম্পিয়ন হন।
এরপর তাম্মাত ভাবলেন ২৫ দিনে নয়, আরও কম সময়ে বাংলাদেশ সাইকেলে পাড়ি দেওয়া সম্ভব। এরপর ঢাকায় আসেন স্পন্সর খুঁজতে। তবে সাড়া পাননি। ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা তুলতে সক্ষম হন তাম্মাতরা। সে সময় অনেকেই সন্দেহ করেছিল, এই ছেলে বাস-ট্রাকে করেও সাইকেল নিয়ে সারা দেশ ঘুরতে পারে। এরপর তিনি ঠিক করলেন সঙ্গে রাখবেন একজন ক্যামেরাম্যান, যিনি লাইভে সব কার্যক্রম দেখাবেন। বাইকসহ আরও দুজন তাম্মাতের সঙ্গী হন। হিসাব করে দেখলেন টাকা প্রয়োজন ১ লাখ ২০ হাজার কিন্তু টাকা আছে ৩০ হাজার। জমানো ৪০ হাজার টাকা নিয়ে শুরু হয় যাত্রা। সেই যাত্রায় সাহস জোগান নাজিউর ও মণি নামে তাম্মাতের দুই সহযোদ্ধা। মণি ভাই বাকি অর্থ জুগিয়ে সহযোগিতা করেন। এরপর শুরু হয় যাত্রা।
নানা রকম বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ১৫ দিনে রাইড শেষ করেন। এটাই এখনো রেকর্ড হয়ে আছে।
তাম্মাতের ভাই তাকে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দিতে থাকেন। করোনার আগে অনূর্ধ্ব ২৩ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য তিনি নির্বাচিত হন। কিন্তু করোনার কারণে আর অংশ নেওয়া হয়নি। এরপর বিভিন্ন বাহিনী থেকে আমন্ত্রণ পেতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত দুবার দুটো দলের হয়ে দুটো পদকও অর্জন করেন।
ছোটবেলা থেকেই তাম্মাত আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের ভক্ত। বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখার সময় করে বসেন অদ্ভুত এক কাণ্ড। মেসির জীবনের ১০০৩তম মেস থাকায় ঘোষণা দেন, আর্জেন্টিনা ট্রফি জিতলে সাইকেলে ১০০৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবেন। আর সেটা উৎসর্গ করা হবে মেসিকে। বিশ্ব কাপের পর তার এই ১০০৩ কিমি. পাড়ি দেওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
২০২২ সালে ফুটবল বিশ্বকাপের সময় তাম্মাত শুরু করেন ব্লগিং। সাইকেল চালানোর সঙ্গে ব্লগিংয়ের মাধ্যমে তুলে ধরতে থাকেন চারপাশের পরিবেশ। যেখানেই যান সেখানকার প্রকৃতি ও চারপাশ উঠে আসে তাম্মাতের ভিডিওতে। ভিডিওতে মাঝে মাঝে সচেতনতামূলক অনুরোধ করেন তাম্মাত।
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নেপালের ইস্টওয়েস্ট হাইওয়ে ১ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়িও দেন।
নেপাল থেকে ফিরে তাম্মাত সিদ্ধান্ত নেন প্রতিদিন ঘুরবেন একটি করে জেলা অর্থাৎ ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা। ৬৪ জেলা ভ্রমণের উদ্দেশ্য- প্রত্যেক জেলার কমিউনিটির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে আগ্রহী ছেলেমেয়েদের অ্যাডভেঞ্চারের জন্য অনুপ্রেরণা দেন।
এর মধ্যেই ভারতের দীর্ঘতম সড়ক কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ৪ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়িও দেন তিনি। তাম্মাত বিশ্বাস করেন, তারুণ্যের শক্তিই পারে দেশকে বদলে দিতে। আর বিশ্বাস নিয়েই তিনি এগিয়ে চলছেন নতুন কিছু করতে।
জাহ্নবী