বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ট্রাভেলার্সদের মধ্য অন্যতম এক নাম কাজী আসমা আজমেরী। ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। ইতোমধ্যে ১৪৫টি দেশ ভ্রমণ করছেন। বর্তমানে তিনি গাম্বিয়ায় রয়েছেন। বাংলাদেশের পাসপোর্ট হওয়ার কারণে তার ভিসা পেতে সমস্যা হয়। তবু বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকার বাহক হিসেবেই ঘুরবেন বিশ্বময়।
আসমা খুলনা শহরে বড় হয়েছেন। কাজী গোলাম কিবরিয়া ও কাজী সাহিদা আহমেদ দম্পতির একমাত্র মেয়ে তিনি। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে স্কুলে আসা-যাওয়া করতেন। এক দিন স্কুল ছুটির পর তার মা নিতে এলেন না। অবশেষে তিনি একাই সাহস করে বাসার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করেন। হাঁটছেন আর তাকিয়ে দেখছেন আকাশটাকে। আকাশ দেখে তার মনে হলো, সে আকাশের শেষ সীমানা দেখবেন। কিন্তু আকাশের শেষ সীমানা আর দেখতে পাওয়া যায় না। সে দিন তিনি বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হেঁটেছিলেন। পরে এলাকাবাসী তাকে ধরে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দেন।
আসমা বড় ইকবালনগর গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং খুলনা মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে স্নাতক এবং ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেন। আসমা থাকেন অস্ট্রেলিয়ার পার্থে। সেখান থেকে সারা দুনিয়া ঘুরে লাটাই-সুতার টানে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। আবার পাখির মতো উড়াল দেন পরবর্তী না দেখা দেশে।
শুধু জনপ্রিয়তার জন্য নয়, আসমা দেশ ভ্রমণ করেন নিজের শখে। শখের বশে ভ্রমণ শুরু করলেও এখন অনুভব করেন, তিনি ভ্রমণের মাধ্যমে নিজ দেশকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরতে পারছেন। সেটা তাকে বেশ আনন্দ দেয়। তার ইচ্ছে ২০২৭ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব দেশ ভ্রমণ পূর্ণ করবেন। ভ্রমণ বিশ্বে বাংলাদেশি হিসেবে ইতিহাস গড়তে চান তিনি। আসমা বলেন, আমার বিশ্ব ভ্রমণের শুরুটা খুব একটা সুখকর ছিল না। ব্যাপারটা হলো, (আমাদের দেশে এমন একটা ধারণা প্রচলিত) বাংলাদেশের মেয়েরা ভ্রমণ করতে পারে না, কিন্তু ছেলেরা পারলে মেয়েরা কেন পারবে না!
২০০৯ সালে নেপাল ভ্রমণ দিয়েই আমার বিশ্ব ভ্রমণের যাত্রা শুরু, বলেন তিনি। তবে শুরুতে ইচ্ছা ছিল ৫০টি দেশ ঘোরার, কিন্তু ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তার ছয় মহাদেশে ভ্রমণ করা দেশের সংখ্যা ১৪২টি।
আজমেরি বলেন, প্রথমে আমার পরিবার ভ্রমণের বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। আমার আব্বু ভ্রমণ খরচ দিতে না চাইলেও আমার মা তার গহনা বিক্রির টাকায় আমাকে খরচ জোগাতে সাহায্য করেন। তবে এটাই শুধু বাধা ছিল না, আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠ লোকেরা আমার একা ঘোরার বিষয়টি নেতিবাচক হিসেবে নেয় এবং আমার বাবাকে তারা অভিযোগ করে যার উত্তরে বাবা আমাকে আমার একা ঘোরার বিষয়টি কাউকে না জানাতে বলেছিলেন। তবে যখন আমি ২০১৮ সালে ১০০টি দেশ ভ্রমণ সম্পন্ন করি, তখন আমার পরিবারের লোকেরা বিষয়টি ইতিবাচক ভাবে নেয়, বিশেষ করে যারা প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন।
বাংলাদেশি পাসপোর্ট হিসেবে অনেক দেশের ভিসা পেতে নানা রকম ভোগান্তি পোহাতে হয়, দীর্ঘদিন লেগে যায়। অনেক দেশের ভিসা পেতে খুব সমস্যা হয়ে যায়। সাউথ আফ্রিকার ভিসা পেতে বলতে গেলে আমার দশ বছর লেগে গেছে। প্রথম ২০১০ সালে যেতে চেয়েছি সাউথ আফ্রিকায়, তখন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখার জন্য যেতে চেয়েছিলাম। তখন বলা হয়েছিল শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে নিতে হবে ভিসা। ২০১১ সালে কলম্বোতে যাই তখন আমাকে বলা হয় ইনভাইটেশন ছাড়া তারা আমাকে ভিসা দেবে না। আমি তাদের বললাম সেখানে তো আমি কাউকে চিনি না, আমি একজন বিশ্ব পর্যটক। তখন তারা আমাকে আমাদের হোম মিনিস্ট্রি থেকে লেটার নিয়ে যেতে বলে। কিন্তু সে সময় আর হয়ে ওঠেনি। আমি যখন নিউজিল্যান্ডে থাকি তখনো চেষ্টা করেছি, ভিসা পাইনি। সর্বশেষ দিল্লি থেকে ভিসা পেয়েছি। এমন নানান ঘটনা আছে, অনেক দেশ আছে যেগুলো ভিসা পেতে আমার খুব বিড়ম্বনা হয়েছে। সেনেগালের ভিসা পেতে ১৬ মাস সময় লেগেছে, আরও অনেক দেশ আছে যেখানে ভিসা পাওয়া অনেক সমস্যা হয়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশিদের জন্য অনেক দেশের ভিসা পাওয়া খুবই কষ্টকর-দুর্লভ, বলতে গেলে পাওয়াই যায় না। সুইডিশ বা অন্য ভালো দেশের পাসপোর্ট হোল্ডার টিকিট কাটছে আর চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশি পাসপোর্টে আমরা অনেক দেশেই যেতে পারি না, ভিসা পাই না।
তিনি আরও বলেন, আমি জর্জিয়া থেকে আজারবাইজানের ভিসা করেছি, সেটা ছিল আমার ৯৬তম দেশ ভ্রমণ। প্রথমে তো তারা ভিসা দেবেই না, তারা বলেছে দিল্লিতে যেতে হবে। আমি প্রতিদিন জর্ডানের অফিসে যেতাম, অনুরোধ করতাম ভিসা দেওয়ার জন্য। অনেক অনুরোধের পর তারা দিয়েছিল ৩ দিনের ভিসা। তারা দেখেছে আমি অনেক দেশ ঘুরেছি।
এরপর টানা দুই বছর অস্ট্রেলিয়ায় চাকরি করার পর আবারো জুন মাসে তিনি ভ্রমণে বের হন। ১৭ জুন সেনেগালে ১৪৪তম দেশ হিসেবে ভ্রমণ করেন। সেখান থেকে জাহাজে তিনি জিংসুয়াং শহরে যান। ২৭ জুন তিনি গাম্বিয়ায় ফিরে আসেন।
জাহ্নবী