দেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধানের ফলন ধারাবাহিকভাবে ভালো হলেও সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যথাক্রমে সরকারের পরিকল্পনায় ঘাটতি, অপর্যাপ্ত ধান-চাল সংগ্রহ, সাইলো বা গুদামের সংকট এবং বাজারজাতকরণে ব্যবসায়ী-মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেটের প্রভাব। এ ছাড়াও খরা ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তৈরির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবদরা।
একটি দেশের সব নাগরিক নিজ নিজ সাধ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণকারী খাদ্যগ্রহণ করতে পারাকেই খাদ্য নিরাপত্তা বলা হয়। এ নিরাপত্তা তখনই নিশ্চিত হয় যখন সংশ্লিষ্ট দেশটির জনসংখ্যার চাহিদা অনুপাতে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্যের মজুত বা স্টক থাকে।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত সাম্প্রতিক এক আলোচনায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, আমাদের দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রধান কারণটি হলো অপর্যাপ্ত খাদ্য মজুত। এর ফলে বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন তৈরি করে আর্থিক ফায়দা লুটতে সুযোগ নেয় ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীর সিন্ডিকেট। এর প্রভাবে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং দাম বেড়ে যায়। এতে করে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টিসম্মত খাদ্যগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ তো রয়েছেই।
ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য কিনে মজুত করতে হবে। এর বিকল্প নেই। আমি মনে করি, ধারাবাহিকভাবে লক্ষ্যমাত্রার বেশি ধানের ফলন একটি শক্তি। এ শক্তির যথাযথ ব্যবহার করলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। সরকার এবারের বোরো ফসল থেকে কমপক্ষে ২০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য শস্য সংগ্রহ করলে সারা বছর বাজার দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের (২০২৩-২৪ অর্থবছরে) বোরো আবাদের ফলন ২ কোটি ২২ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে। যা আগের বছর (২০২২-২৩ অর্থবছরে) ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী খবরের কাগজকে বলেন, ধারাবাহিকভাবে বোরো আবাদের জমির পরিমাণ বছর বছর বাড়ছে।
গত অর্থবছরে ৪৮ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে আবাদি জমির পরিমাণ বেড়ে হয় ৫০ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর।
এদিকে, খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংগ্রহ-চলতি দায়িত্ব) মো. মনিরুজ্জামান খবরের কাগজকে জানান, গত ২১ এপ্রিল খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এবার বোরো ধানের ফলন থেকে ১৭ লাখ টন ধান ও চাল কিনবে সরকার। এর মধ্যে ৫ লাখ টন ধান, ১১ লাখ টন সেদ্ধ চাল ও ১ লাখ টন আতপ চাল রয়েছে। এ ছাড়াও ৫০ হাজার টন গম সংগ্রহ করা হবে।
তিনি জানান, আগের বছর মোট সাড়ে ১৬ লাখ মেট্রিক টন ধান ও চাল সংগ্রহ করা হয়েছিল। সরকার তার সংগ্রহ করা খাদ্যশস্যের মজুত থেকে সবচেয়ে বেশি বিতরণ করে বিভিন্ন বাহিনীর মাসিক রেশনের চাল ও আটা। এ ছাড়া যেসব কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জন্য খাদ্যশস্য বিতরণ করে সেগুলো হলো টেস্ট রিলিফ (টিআর), গ্র্যান্ট রিলিফ (জিআর), কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা), ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কর্তৃক কার্ডের বিপরীতে স্বল্পমূল্যে বিক্রি।
দেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের তুলনায় সরকারের সংগ্রহের পরিমাণকে অপর্যাপ্ত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদগণ। খাদ্যশস্য সংগ্রহের এ স্বল্প পরিমাণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় গুদাম বা সাইলোর অভাব। এদিকে, দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক গুদাম অব্যবহৃত বা পরিত্যক্ত করে রাখার অভিযোগও রয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ২০১৪ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে খাদ্য গুদাম নির্মাণ, পুরোনো ও জরাজীর্ণ হয়ে পড়া গুদাম সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে।
তিনি জানান, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাওরাঞ্চল, চর ও বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে ৪ লাখ পরিবারকে পারিবারিক খাদ্যশস্য মজুতের জন্য ফুড গ্রেডেড প্লাস্টিকের তৈরি পাত্র বিতরণ করা হয়েছে। এটিকে ‘পারিবারিক সাইলো’ নাম দেওয়া হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে আপৎকালীন এক মাসের খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে রাখা সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির পরিচালক রেজাউল করিম শেখ খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো, বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি ভেঙে বা বন্যায় ভেসে গেলেও ওই পাত্রটি বা প্লাস্টিকের সাইলোতে সংরক্ষিত খাদ্যশস্যের মান খাবার উপযোগী থাকবে। খাদ্যগুণ নষ্ট হবে না। এটিও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এক ধরনের প্রচেষ্টা।
এ ছাড়াও সরকার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধান শুকানো, সংরক্ষণ ও আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ আধুনিক ধানের সাইলো নির্মাণ করছে। প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব শহীদুল আলম এনডিসি জানান, ২০২১ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের আওতায় দেশের ২৪ জেলার মোট ২৯ উপজেলায় ৩০টি সাইলো নির্মাণাধীন রয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে গুদাম বা সংগ্রহশালার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে কাজ করছে। এসব অবকাঠামো নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হলে সরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্য সংগ্রহের পরিমাণও বাড়বে।
এদিকে সরকার সেচের আওতা বৃদ্ধি, ভর্তুকি মূল্যে সার বিতরণ ও কৃষি ঋণের প্রসারের মাধ্যমে প্রতি বছর খাদ্য শস্য উৎপাদনে আবাদি জমির পরিমাণ বাড়াতে চেষ্টা করছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ রয়েছে ৮৮ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে বিদ্যমান সেচ ব্যবস্থার আওতায় আছে ৭৮ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর জমি। বোরো আবাদে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ হেক্টর জমি ব্যবহৃত হয়। অবশিষ্ট জমি এখনো এক বা দুই ফসলি।