এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয় ২০১০ সালে। এ প্রকল্পটির বয়স ১৫ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু এখনো পুরো কাজ শেষ হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের এটি একটি উদাহরণ মাত্র। কমপক্ষে ৩৫৭টি প্রকল্প ৬ থেকে ১০ বছরের মধ্যেও শেষ হয়নি। প্রকল্প গ্রহণ ও পরিচালনায় দূরদর্শিতার অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির এই দুর্বলতার কারণে সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকের অন্তর্ভুক্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পও এমন দীর্ঘ সময় ধরে বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এসব ভারী প্রকল্পের পাশাপাশি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে শেওলা, ভোমরা ও রামগড় স্থলবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নয়নের মতো ছোট প্রকল্পও দীর্ঘদিনে বাস্তবায়ন হয়নি। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটেও এসব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, ৩৫৭টি প্রকল্পের বয়স ৬ থেকে ১০ বছর। আগামী এডিপিতে স্থান পেয়েছে ৫৭টি নতুন প্রকল্প। আগের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প আছে ১ হাজার ১৮৯টি। এর মধ্যে ১০ বছরের বেশি বয়স হয়েছে, এমন প্রকল্পের সংখ্যা ৩৬ এবং ৫ বছরের বেশি সময় ধরে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প ৭৪৫টি। মোট প্রকল্প ১ হাজার ২৪৬টি।
এবারের এডিপিতে নতুন প্রকল্প রয়েছে ৫৭টি। পূর্ববর্তী অর্থবছরে অনুমোদন পেয়েছে, কিন্তু বরাদ্দ পায়নি এমন আরও ৫১ প্রকল্পও আগামী অর্থবছরের এডিপিতে স্থান পেয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশ্লেষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সিপিডির বিশ্লেষণে বলা হয়, এডিপির প্রকল্পসমূহের ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রকল্প চারবার সংশোধিত হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বারবার বর্ধিত মেয়াদ পাওয়া এসব প্রকল্পের সংখ্যা ৫১৮।
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত আলোচিত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক পাল্টেছে একে একে ছয়জন। বছরের পর বছর চলে গেলেও প্রকল্প এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমান প্রকল্প পরিচালক মো. সবুক্তগীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘পুরো প্রকল্প থেকে রামু-ঘুমধুম অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত অবকাঠামো নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হতে আরও দুই মাস লাগবে। এরপর টেস্টিং ও কমিশনিং শেষে পুরোপুরি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। বর্তমানে সীমিত আকারে রেলপথটি চালু করে যাত্রী চলাচল করা হচ্ছে।’
আইএমইডির পরিচালক ড. মো. তায়েবুর রহমান এক গবেষণাপত্রে বলেছেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা ও বিলম্বের একটি বড় কারণ হলো পর্যাপ্ত সম্ভাব্যতা যাচাই ও অংশীজনের মতামতের অভাব।’
তার মতে, ‘দ্বিতীয় বড় কারণ দুর্বল প্রকল্প ডকুমেন্ট এবং তৃতীয় কারণ হলো ডিপিপিতে (ড্রাফট প্রজেক্ট প্রপোজাল) কোনো এক্সিট প্ল্যান না থাকা। এসব কারণে প্রকল্প সরকার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বারবার সমস্যার সম্মুখীন হয়। এতে বারবার সংশোধন ও সময় বাড়ানো প্রয়োজন হয়।’
সিপিডি জানায়, প্রস্তাবিত বাজেটের এডিপিতে সাধারণ ও বিনিয়োগ প্রকল্পের বেশির ভাগই নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়নি। বছরের পর বছর ধরে বারবার একই প্রকল্প এডিপিতে স্থান পায়। মেয়াদ শেষ হয়, কিন্তু প্রকল্পের বাস্তবায়নকাজ শেষ হয় না।
কোনো কোনো প্রকল্প কোনো অর্থবছরে নামমাত্র বরাদ্দ পেয়ে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে প্রকল্পের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। ফলে জনগণ কিংবা রাষ্ট্র এসব প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবছর এ ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় নানা রকম চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা বা বিলম্ব আমাদের সক্ষমতার ঘাটতির নির্দেশনা দেয়। এ নিয়ে অতীতেও অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু কোনো উন্নতি আমরা দেখিনি। সমস্যা হলো, একটি বিনিয়োগ প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে না পারলে ব্যয় বাড়ে এবং লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রিটার্ন পাওয়া যায় না। এটি তাৎক্ষণিক না হলেও দীর্ঘমেয়াদে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সাধারণ উন্নয়ন প্রকল্প যদি সময়মতো সম্পন্ন না হয়, তা হলে রাষ্ট্রের কষ্টার্জিত অর্থের অপচয় হয় এবং জনগণ প্রত্যাশিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের একটি বড় অংশ বিদেশি ঋণে বাস্তবায়ন করা হয়। সুতরাং এসব প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন না হলে ঋণের দায় ও ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ে। এটি মূল্যস্ফীতির উচ্চহার সৃষ্টি ও আমদানি-রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে।’
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি যে আগামী বাজেটে ঋণ পরিশোধে সরকার ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার মতো বরাদ্দ রেখেছে। সুতরাং ঋণের দায় ও চাপ আগামীতে আরও বাড়লে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ আরও ঘনীভূত হবে। ঋণের বিকল্প হলো সরকারের রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি। কিন্তু সেটি তো সরকার করতে পারছে না।’
গত ৬ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এমপি সংসদে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন। আগামী ৩০ জুন এ বাজেট পাস হওয়ার কথা রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এর সিংহভাগ সরকারের পরিচালন ব্যয়। এর মধ্যে এডিপিতে বরাদ্দ ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। অবশিষ্ট ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার জোগান হবে দেশি-বিদেশি ঋণ থেকে।