যশোর-খুলনা অঞ্চলে প্রায় ১০০ অনুমোদনহীন রেলক্রসিং গেটের কারণে একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। আবার কোথাও কোথাও অনুমোদিত রেলগেটের গেটম্যানের দায়িত্বে অবহেলারও অভিযোগ রয়েছে। তবে রেলওয়ে বলছে, সড়ক বিভাগ রাস্তা করার কারণে ক্রসিংগেট তৈরি হয়েছে, যা বাংলাদেশ রেলওয়ে জানে না। এ জন্য এসব গেট অনুমোদনহীন বলা হয়।
সরেজমিনে ও রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, যশোর থেকে অভয়নগর উপজেলার ব্যস্ততম শিল্পশহর নওয়াপাড়া এলাকার ৩০ কিলোমিটার রেলপথে ৪৫টি ক্রসিংয়ের মধ্যে ৩৬টিতে কোনো গেটম্যান নেই। একই অবস্থা রয়েছে যশোর জংশন থেকে বারোবাজার পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রেলপথের। এ এলাকায় অন্তত ১২ স্থানে রেলক্রসিং গেট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যশোর সাব-ডিভিশনের আওতায় খুলনা থেকে যশোরের শানতলা ও বেনাপোল পর্যন্ত ১১১ কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে। এ পথে যাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আর এসব উন্মুক্ত রেলগেট দিয়ে যানবাহন এবং লোক চলাচল করতে গিয়ে হরহামেশা দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।
নওয়াপাড়া গার্লস স্কুল সড়কের মুদি ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন জানান, গুরুত্বপূর্ণ গেটে কোনো গেটম্যান না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। আকিজ জুট মিল গেটসংলগ্ন রেলগেটটি উন্মুক্ত। রেলগেট দিয়ে আকিজ জুট মিল ও আকিজ আইডিয়াল স্কুল-কলেজে যাওয়ার পথ। ফলে এ পথে অনেক ভারী ও হালকা যানবাহন নিয়মিত চলাচল করে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ রেলগেটে নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা না থাকার পরও মানুষকে পারাপার হতে হচ্ছে।
ট্রাকচালক আকরাম হোসেন জানান, রাতে ট্রেনের আলো দেখে অনেক রেলগেটের ওপর দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে চলাচল করতে হয়। কিন্তু দিনে ট্রেন আসছে কি না, তা বোঝা যায় না। ফলে রেলগেটে গাড়ি থামিয়ে দুই পাশ দেখে পারাপার হতে হয়। একের পর এক মানুষ ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেলেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
এদিকে শহরের ধর্মতলা এলাকার আবু সাঈদ রানা জানান, তাদের এলাকায় একটি অরক্ষিত রেলক্রসিং রয়েছে। গেটম্যান না থাকায় তারা ঝুঁকি নিয়েই যাতায়াত করেন।
সদর উপজেলার চূড়ামনকাটি বাজারের মাহবুবুর রহমান জানান, তাদের এলাকার বারিনগর বাজারে রয়েছে একটি অরক্ষিত রেলগেট।
স্থানীয়রা জানান, বারোবাজারের আগে মান্দারতলা রেলক্রসিং গেটে ২০০৯ সালে বিয়ে করতে যাওয়ার সময় একটি মাইক্রোবাস রেলের ধাক্কায় একই পরিবাররের চারজনসহ প্রাণ হারান পাঁচজন। এ দুর্ঘটনায় স্বামী হারান বর্তমানে যশোরের আব্দুর রাজ্জাক কলেজের লাইব্রেরিয়ান প্রভাষক রুমি আক্তার।
২০১৪ সালের ১ আগস্ট বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যশোর-কালীগঞ্জ রেলপথের বারোবাজার রেলক্রসিংয়ে। এদিন ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ যায় ১১ বরযাত্রীর। সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে বরযাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষে তারা মারা যান। এদের মধ্যে একই পরিবারের তিনজন সদস্য ছিলেন। আহত হন অন্তত ৪০ জন। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি গ্রামের স্কুলশিক্ষক তাপস বিশ্বাসের বিয়েতে তারা ৮০ জনের মতো বরযাত্রী হিসেবে কালীগঞ্জ উপজেলার সাকো-মথনপুর গ্রামে যান। রাত তিনটার দিকে তারা ফুলহরির উদ্দেশে রওনা দেন। ভোর চারটার দিকে বাসটি বারোবাজার রেলক্রসিংয়ে ওঠামাত্র দুর্ঘটনা ঘটে।
সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর যশোর সদর উপজেলার চূড়ামনকাটি রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে ট্রাকের চালক ও হেলপার নিহত হন। এতে ট্রাকটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ঘটনার সময় রেলক্রসিংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী ঘুমিয়ে ছিলেন ও ক্রসিংয়ের ব্যারিয়ার (প্রতিরোধক দণ্ড) তোলা ছিল বলে স্থানীয়রা জানান। ঘটনার পর রেলক্রসিংয়ের গেটম্যান পলাতক ছিলেন। দায়িত্বে অবহেলার কারণে গেটম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। নিহতরা হলেন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার কাগমারী গ্রামের বাহাদুর মিয়ার ছেলে ট্রাকচালক পারভেজ হোসেন (৫০) ও মহেশপুর উপজেলার আজমপুর গ্রামের মৃত শহিদুল ইসলাম ওরফে শহিদের ছেলে হেলপার নাজমুল ইসলাম (৪০)।
যশোর রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, যশোর-খুলনা অঞ্চলে মোট রেলক্রসিং গেট রয়েছে ১৭১টি। এর মধ্যে অনুমোদনহীন হচ্ছে ৭৮টি। আর ১৫টি অনুমোদিত গেটে নেই গেটম্যান। শুধু যশোর অঞ্চলে রয়েছে ১৬০টি রেলগেট। এর মধ্যে অনুমোদনহীন ৭৬টি। আর খুলনা অঞ্চলে ১১টি গেটের মধ্যে অনুমোদন নেই ২টির।
যশোর রেলওয়ে জংশনের স্টেশনমাস্টার আইনাল হাসান খবরের কাগজকে বলেন, স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়া ও ঢোকার সময় গেটম্যানদের ফোনে সতর্ক করা হয়। তাদের কাজে গাফিলতি করার সুযোগ নেই। তবে তিনি সব সময় মানুষ কর্মস্থলে থাকতে পারে না বলে জানান।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক আহম্মদ হোসেন মাসুম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের কোনো অরক্ষিত গেট নেই। সড়ক বা সেতু বিভাগ রাস্তা করায় ক্রসিংগেট তৈরি হয়েছে, যা বাংলাদেশ রেলওয়ের অনুমোদনহীন। বারবার এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অবগত করেছি। তারা রেলগেট ব্যবহার করছেন রেলকে না জানিয়ে। এগুলো ব্যবহারে ঝুঁকি বাড়ছে।’
তবে তিনি অনুমোদনহীন রেলগেটের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা অবহিত করলে সেটা বিবেচনায় নিয়ে গেটম্যান নিয়োগ করবেন বলে জানান।
আহম্মদ হোসেন মাসুম গেটম্যানসংকটের বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের জনবল কিছু কম থাকলেও অন্যরা দায়িত্ব পালন করেন। অনুমোদিত রেলক্রসিংয়ের গেটম্যানদের জন্য প্রতিটি লেভেল ক্রসিংয়ের আগেই তাদের প্রতীক দেওয়া রয়েছে। ট্রেনচালকদের ওই প্রতীক দেখে হুইসেল বাজানোর নির্দেশনা রয়েছে।’