![হাকালুকি হাওরে শিকারির ফাঁদে অতিথি পাখি](uploads/2024/01/14/1705217295.birds.jpg)
ঋতুচক্রের পরিক্রমায় হেমন্তের পরেই আসে শীত। আর শীতের আগমনে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকিতে আসতে শুরু করে নাম না জানা অসংখ্য অতিথি পাখি। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও পরিবেশ রক্ষায় উপকারী বন্ধু পাখি। কিন্তু সেই নিরীহ পাখি হাওরাঞ্চলের পথে প্রান্তরে কিছু লোভী শিকারির শিকারে পরিণত হয়।
সম্প্রতি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওরের জুড়ীর অংশে নাগুয়া ও চাতলার বিলে বিষটোপসহ শিকারিদের ফাঁদ তাদের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। সামান্য আয়ের লোভে হাকালুকিতে অতিথি পাখি শিকার করছেন অনেকেই। যার ফলে এ বছর পাখিদের বিচরণ কমে গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে হাকালুকি হাওরে নানা প্রজাতির পাখি আসে। এসব পাখির মধ্যে রয়েছে বালিহাঁস, ভুতিহাঁস, গিরিয়াহাঁস, ল্যাঞ্জাহাঁস, গুটি ইগল, কাস্তেচরা, কুড়া ইগল, সরালি, পানভুলানি, কালিম, সাদা বক, কানি বক, পানকৌড়ি। এর মধ্যে দেশীয় প্রজাতির নানা জাতের পাখি রয়েছে।
হাওরপাড়ে বসবাসকারী স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, হাকালুকি হাওরে অসাধু শিকারিরা বিষটোপ আর ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করায় দিন দিন অতিথি পাখির আগমন কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে শীতে হাওরে অতিথি পাখি আসার সঙ্গে সঙ্গে পাখি শিকারিরা তৎপর হয়ে ওঠেন।
গত সপ্তাহে হাকালুকি হাওরের জুড়ীর অংশে নাগুয়া ও চাতলার বিলে পাখি দেখতে ও ছবি তোলার জন্য যান চারজন আলোকচিত্রী। তারা হলেন- সৈয়দ আব্দুল, শাহানুল করিম চপল, মো. রিজওয়ানুল করিম ও সুলতান আহমদ। তারা হাকালুকির নাগুয়া বিলে ৩২টি পাখির মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে এ সময় মৃত পাখিগুলো মাটিচাপা দেন তারা। এ ঘটনা তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিসহ পোস্ট দেওয়ার পরই মুহূর্তেই বিষয়টি ভাইরাল হয়ে যায়।
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, শিকারিরা দলবেঁধে বিষটোপ ও জাল দিয়ে পরিযায়ী পাখি শিকার করে। তারা সেসব পাখি গোপনে চড়া দামে বিক্রি করে।
হাকালুকি হাওরে অন্য বছরের তুলনায় এবার পাখির সংখ্যা তুলনামূলক কম বলে জানান চাতলা বিলের ইজারাদার জমির মিয়া।
এদিকে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাকালুকি হাওরের প্রতিজোড়া পাখি ১ হাজার থেকে ১৫শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। অনেকে অগ্রিম অর্ডার দিয়েও রাখেন। এ কাজটা শিকারিরা খুবই সতর্কতার সঙ্গে করে থাকেন।
পাখি শিকারিদের তৎপরতা দুঃখজনক মন্তব্য করে স্ট্যাড অর আওয়ার ইন্ডেঞ্জার ওয়াইল্ড লাইফের যুগ্ম আহ্বায়ক রিপন দে বলেন, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছর জেল, ১ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডও হতে পারে। একই অপরাধ ফের করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণের বিধানও রয়েছে।
কোনো ব্যক্তি পরিযায়ী পাখির মাংস ও দেহের অংশ সংগ্রহ বা দখলে রাখলে অথবা বেচাকেনা করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার জাতীয় পরিষদ সদস্য আ স ম সালেহ সোহেল বলেন, এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাকালুকি হাওরে কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে অবাধে চলছে পাখি শিকার। পাখি শিকারিরা সবসময় তৎপর থাকলেও যথাযথ কর্তৃপক্ষ রয়েছে অন্ধকারে। পাখি শিকার বন্ধে বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় কোনোভাবেই থামছে না পাখি শিকার।
এ বিষয়ে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজারের রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম ছারওয়ার জানান, এ এলাকায় যারা শিকারের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়াও পাখি শিকার রোধে মানুষকে সচেতন করতে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে।
হাকালুকি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও সিলেটের পাঁচটি উপজেলার ১৮১ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। এখানে ছোট-বড় ২৭৩টি বিল, ১০টি নদী ও অসংখ্য খাল রয়েছে। এই জলাভূমিতে পরিযায়ী পাখি শিকার সরকারের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি একে ১৯৯৯ সালে পরিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।