![রেলের লাইনে মরণফাঁদ](uploads/2024/02/14/1707890836.Mymensing-Railway.jpg)
ময়মনসিংহ সদরের কেওয়াটখালী এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ব্রিটিশ আমলে একটি রেলসেতু বানানো হয়। ৯০০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুর ওপর দিয়ে প্রায় ১৫০ বছর ধরে ট্রেন চলাচল করছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, কাঠের স্লিপারে পচন ও নাটবোল্ট চুরির কারণে এই সেতুটি এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই সেতুর ওপর দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ট্রেনগুলোকে ময়মনসিংহ শহরে ঢুকতে হয়। নগরীর শম্ভুগঞ্জ স্টেশনের কাছে আরও একটি ছোট সেতু রয়েছে, সেটারও একই অবস্থা।
রেলযাত্রাকে আরও বিপজ্জনক করেছে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং। ময়মনসিংহ রেলওয়ে অঞ্চলে প্রায় ২০০টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর বেশির ভাগই অরক্ষিত। ট্রেন আসা-যাওয়ার সময় কোনো সিগন্যাল না পাওয়ায় গেট কিপাররা ঘড়ি দেখে গেট ব্যারিয়ার ফেলেন। অনেক লেভেল ক্রসিংয়ে গেট ব্যারিয়ারও নেই। এতে প্রায় সময়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
সবশেষ গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর নেত্রকোনার দুর্গাপুরের জারিয়া থেকে আসা বলাকা কমিউটার ট্রেন ময়মনসিংহ নগরীর শম্ভুগঞ্জের চর রঘুরামপুর এলাকায় ক্রসিং পার হচ্ছিল। সেখানে ব্যারিয়ার না থাকায় দুপুর দেড়টার দিকে বালুবোঝাই একটি ট্রাক রাস্তা থেকে লাইনে উঠে পড়ে। ট্রেনের ধাক্কায় পাশে ছিটকে পড়ে ট্রাকটি। আর ট্রেনটি প্রায় এক কিলোমিটার সামনে গিয়ে থেমে যায়। এতে ঘটনাস্থলে চারজন নিহত হন। চারজনই ট্রেনের যাত্রী।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন হয়ে ময়মনসিংহ-ঢাকা, ভৈরব, মোহনগঞ্জ, জারিয়া-ঝাঞ্জাইল ও জামালপুরগামী পাঁচটি রেলপথ রয়েছে। রেলওয়ের ময়মনসিংহ সাব-ডিভিশনের অধীন ময়মনসিংহ-শ্রীপুর সেকশনে ৯২টি, ময়মনসিংহ-বিদ্যাগঞ্জ সেকশনে ৩২টি, ময়মনসিংহ-গৌরীপুর এবং গৌরীপুর-আঠারোবাড়ী সেকশনের প্রতিটিতে ২৭টি করে, গৌরীপুর-মোহনগঞ্জ সেকশনে ৮২টি, শ্যামগঞ্জ-জারিয়া সেকশনে ২৫টিসহ মোট ২৮৫টি ছোট-বড় রেলসেতু ও কালভার্ট রয়েছে।
কেওয়াটখালীর ব্রহ্মপুত্র নদের ওপরের সেতুতে কথা হয় জাহিদুল ইসলাম নামে একজনের সঙ্গে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘রেলসেতুটিতে রেলিং বা সেইফ গার্ড নেই। পথচারীরা ট্রেন এলে আতঙ্কে থাকেন। রেলিং দেওয়ার জন্য স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দেয়নি। এরমধ্যে মাদকসেবীরা টাকার জন্য লাইন থেকে প্রায়ই হুক, বোল্ট ও ডগস্পাইক (কাঠের স্লিপারের সঙ্গে লোহার পাতি আটকে রাখার আংটা) খুলে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে আতঙ্ক আরও বাড়ছে।’
সারোয়ার হোসেন নামে আরেকজন বলেন, ‘ময়মনসিংহের বিভিন্ন রেললাইনে পুরনো কাঠের স্লিপারগুলো পচে নষ্ট হচ্ছে। রেললাইনের বেহাল অবস্থার কারণে প্রায়ই ইঞ্জিন ও বগি লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। দ্রুতগতি ও উন্নত সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন যাত্রীরা।’
ময়মনসিংহ শহরের সি কে ঘোষ রোড হয়ে প্রতিদিন নগরীর বিসিক শিল্প নগরীতে কাজে যান শরীফ মিয়া নামে এক তরুণ। তিনি মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করেন। বলেন, ‘মিন্টু কলেজের সামনের রেলক্রসিংয়ে দীর্ঘদিন পর গেট ব্যারিয়ার দেওয়া হয়েছে। তবে সঠিক নিয়মে গেট ব্যারিয়ার ফেলা হচ্ছে না। এটা ফেলার সময় বিভিন্ন যানবাহন অপেক্ষা করলেও ব্যারিয়ারের পাশে ফাঁকা অংশ থাকায় মোটরসাইকেল যাতায়াত করছে। এক মোটরসাইকেলের পেছনে আরেক মোটরসাইকেল হুড়োহুড়ি করে যাওয়া-আসা করায় ঝুঁকি বাড়ছে। এ ছাড়া যেখানে গেট ব্যারিয়ার নেই সেখানে পথচারী ও যানবাহনগুলোকে আরও ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।’
সামাজিক সংগঠন জনউদ্যোগের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু খবরের কাগজকে বলেন, ‘বড় ধরনের দুর্ঘটনার আগেই পুরোনো কাঠের সবগুলো স্লিপার পাল্টানো প্রয়োজন। রেললাইনে দেওয়া যন্ত্রগুলোর চুরি রোধে কর্তৃপক্ষের আরও সচেতন হতে হবে। সব লেভেল ক্রসিংয়ে গেট ব্যারিয়ার দিতে হবে। মানুষের মৃত্যুর আগেই কর্তৃপক্ষের সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। আশা করছি কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়গুলো সমাধানে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করবে।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী আকরাম আলী খবরের কাগজকে বলেন, রেললাইনের সব অংশেই রেলের কর্মীরা যথাযথভাবে পাহারা দিচ্ছেন। এরপরও মাঝে মধ্যে মাদকসেবীরা টাকার জন্য হুক, বোল্ট চুরি করে নিয়ে যায়। পচে যাওয়া কাঠের স্লিপারগুলো চিহ্নিত করে পাল্টানো হয়। রেল চলাচল নিরাপদ করতে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। এ ছাড়া দীর্ঘদিনে কিছু গেট ব্যারিয়ার ভেঙে গিয়ে অকেজো হয়ে গেছে। সব লেভেল ক্রসিংয়ের তালিকা করে কোথাও গেট ব্যারিয়ার না থাকলে লাগানো হবে। আমরা চাই রেলযাত্রা নির্বিঘ্ন হোক।