গাজায় ইসরায়েলের হামলার ছয় মাস পর যুদ্ধ, রোগ, অনাহার ও মৃত্যুতে বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনিরা। গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল তাদের নৃশংস হামলা শুরু করার পর ছয় মাস হয়ে গেছে। তবে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কারণ তার মিত্ররা রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের ওপর ব্যবহার করার জন্য ইসরায়েলকে আরও অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে। অন্যদিকে মধ্যস্থতামূলক আলোচনাতেও যুদ্ধবিরতির মতো কোনো ফল আসেনি।
ইসরায়েল বলছে, গাজায় যুদ্ধ গাজা থেকে হামাসের কাসাম ব্রিগেডের নেতৃত্বে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামলার প্রতিশোধ। এই যুদ্ধে তাদের ১ হাজার ১৩৮ জন নিহত এবং প্রায় ২৫০ জন বন্দি হয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে অন্তত ৩৩ হাজার ১৩৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
ধসে পড়া ভবন ও অবকাঠামোর ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ রয়েছে এবং তারা মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেন বলেছে, এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৮০০-এর বেশি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু ও নারী। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৭৫ হাজার ৮১৫ জন আহত হয়েছে, এটি গাজার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে চারজন।
প্যালেস্টাইন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বলেছে, গাজার প্রায় এক হাজার শিশু তাদের এক বা উভয় পা হারিয়েছে। নিরলস ইসরায়েলি হামলার মধ্যে এখনো প্রতিদিন কয়েক ডজন মানুষ নিহত ও আহত হচ্ছে।
ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ করছে মানুষ
২০২৪ সালে গাজার মানবিক পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ হয়েছে। কারণ ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সাহায্য সংস্থাগুলোকে গাজায় প্রবেশে বাধা দেয় এবং যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে কার্যকরভাবে অনাহার চাপিয়ে দিয়েছে। গাজায় আটকে পড়া প্রায় ২৩ লাখ মানুষ এখন অনাহারে ভুগছে। জাতিসংঘ বলছে, মে মাসের মধ্যে গাজার বিভিন্ন অংশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।
ইসরায়েলি স্থল আগ্রাসনে প্রথম ধ্বংস হওয়া উত্তর গাজা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ইসরায়েল উত্তরে প্রবেশাধিকার কঠোরভাবে সীমিত করে চলেছে। তারা রুটগুলোকে অবরুদ্ধ করেছে এবং এর ফলে সাহায্য নিয়ে আসা বহরগুলোকে সাহায্য দেওয়া বিলম্বিত বা বাতিল করতে বাধ্য করছে।
উত্তর গাজায় পানিশূন্যতা ও অপুষ্টির কারণে নবজাতক ও ছোট শিশুরা মারা গেছে। কিন্তু ইসরায়েল এখনো অনেক মানবিক মিশনকে গাজায় যেতে বাধা দিচ্ছে।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে ২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ গাড়ির একটি বহরকে লক্ষ্য করে পরপর তিনটি হামলায় সাত বিদেশি সাহায্যকর্মীকে হত্যা করেছে। এই হত্যা, কিছু সাহায্যকারী সংস্থাকে পরিষেবা স্থগিত করতে প্ররোচিত করেছে।
১৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যুদ্ধের শুরু থেকেই ফিলিস্তিনিদের ‘দক্ষিণে যেতে’ নির্দেশ দেয়, কারণ তার স্থলবাহিনী উত্তর থেকে গাজা আক্রমণ করেছিল। তখন থেকে উত্তর গাজায় কেউ তাদের বাড়িতে ফিরতে পারেনি। কারণ ফিলিস্তিনকে দুই ভাগ করে ইসরায়েল একটি সামরিক করিডর স্থাপন করেছে।
প্রায় ১৯ লাখ বা গাজার জনসংখ্যার ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বেশির ভাগই স্কুল ও হাসপাতালের মতো জাতিসংঘের স্থাপনায় আশ্রয় নিচ্ছে। তা সত্ত্বেও সেসব আশ্রয়ের জায়গাগুলোতে চালানো ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ৪০০ জনের বেশি নিহত এবং কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ জন আহত হয়েছে। মিসরের সীমান্তে গাজার দক্ষিণতম শহর রাফায় এখন ১৫ লাখেরও বেশি মানুষ আটকে আছে। ইসরায়েলি বিমান হামলার শিকার হয়ে অনেকেই অস্থায়ী ক্যাম্পে বা রাস্তায় থাকতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি ইসরায়েল জোর দিয়ে বলেছে যে তারা স্থলপথেও রাফা আক্রমণ করবে।
ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) বলেছে, তাদের ভবনগুলোকে লক্ষ্য করে ৩৫০টিরও বেশি ইসরায়েলি সামরিক হামলা হয়েছে। এতে ১৬১টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় জাতিসংঘের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক ১৭৬ জন কর্মী নিহত হয়েছেন।
কতটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো গাজা
এই যুদ্ধ গাজার সব বাড়ির প্রায় ৬২ শতাংশ বা ২ লাখ ৯০ হাজার ৮২০ আবাসন ইউনিটকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করেছে। সেই সঙ্গে ১০ লাখের বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের হিসাবে পাবলিক সার্ভিস অবকাঠামোর আনুমানিক ১ হাজার ৮৫০ কোটি (১৮ দশমিক ৫০ বিলিয়ন) ডলার ক্ষতি হয়েছে, যেখানে ২ কোটি ৬০ লাখ টন ধ্বংসাবশেষ ও ধ্বংসস্তূপ অবশিষ্ট রয়েছে।
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তথাকথিত সন্ত্রাস মোকাবিলার প্রচেষ্টায় ইসরায়েলি স্থল ও বিমান হামলায় হাজার হাজার বাড়িঘর ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। ইউনিসেফের মতে, গাজার প্রতি ১০টির মধ্যে ৮টি স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। ৬ লাখ ২৫ হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
হাসপাতালগুলোও অকার্যকর হয়ে পড়েছে
আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সুরক্ষা সত্ত্বেও গাজাজুড়ে হাসপাতালগুলোতে আক্রমণের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তাদের দাবি, হামাস হাসপাতালের ভেতরে ও নিচে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সব হাসপাতাল গুরুতর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ৩৬টির মধ্যে মাত্র ১০টি আংশিকভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সেগুলোও ক্রমবর্ধমান অতিরিক্ত চাপের মধ্যে রয়েছে।
গত সপ্তাহে গাজার সর্ববৃহৎ আল-শিফা হাসপাতালে এবং তার আশপাশে দুই সপ্তাহের অবরোধ, এটিকে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ও পুড়িয়ে ফেলেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তার অবরোধের সময় কম্পাউন্ডে কমপক্ষে ৪০০ জনকে হত্যা করে এবং আরও শতাধিক ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করে।
ওষুধের তীব্র সংকট এবং সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের ক্লান্ত ও অনাহারে থাকার অর্থ হলো, বেশির ভাগ রোগীই গাজায় চিকিৎসা নিতে পারছে না। অন্যদিকে চেতনানাশক ছাড়াই অনেক অপারেশন এবং অঙ্গচ্ছেদ করতে হয়েছে।
সাংবাদিকরাও ইসরায়েলি বর্বরতার শিকার
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যেকোনো আধুনিক সংঘাতের মধ্যে গাজা যুদ্ধেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সাংবাদিককে হত্যা করেছে এবং ২৪ জনের বেশি সংবাদকর্মীকে আটক করেছে। ১৮ মার্চ আল-জাজিরার সংবাদদাতা ইসমাইল আল-ঘৌলকে ১২ ঘণ্টা ধরে আটকে রাখা হয়েছিল এবং আল-শিফা হাসপাতালে ইসরায়েলি বাহিনী তাকে মারধরও করেছিল।
এর আগে গত ৭ জানুয়ারি খান ইউনিসে, গাজার ব্যুরো চিফ ওয়ায়েল দাহদুহের ছেলে আল-জাজিরার সাংবাদিক হামজা দাহদৌহ ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নিহত হন। তিনি হামজা আল-মাওয়াসির কাছে একটি গাড়িতে ছিলেন আরেক সাংবাদিক মুস্তফা থুরায়ার সঙ্গে। হামলায় থুরায়াও নিহত হন।
২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বরে আল-জাজিরার ক্যামেরাম্যান সামের আবুদাকা ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় আহত হয়েছিলেন। গাজার খান ইউনিসে এই হামলায় ওয়ায়েল দাহদুহও আহত হয়েছেন। আবুদাকা নামের আরেক সাংবাদিক ৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে রক্তপাতে মারা যান। জরুরি কর্মীরা তার কাছে পৌঁছাতে পারেননি, কারণ ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের অনুমতি দেয়নি।
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের তথ্যমতে, নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ৯০ জন। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস বলেছে, এবারের যুদ্ধে প্রায় ১৪০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
গত সপ্তাহে আল-আকসা মার্টায়ারস হসপিটালের আঙিনায় সাংবাদিকদের একটি তাঁবুকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত চারজন নিহত এবং একাধিক সাংবাদিক আহত হন।