![একা এগিয়ে গিয়েছিলেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর](uploads/2023/12/05/1701751528.Lubna-Marium.jpg)
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। আমরা তখন মহিদিপুর ক্যাম্পে। আমাদের পুরো পরিবার মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে ছিল। মা সুলতানা জামান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। বাবা তখন ৭ নম্বর সেক্টরে সম্মুখযুদ্ধে। সেদিন মহানন্দা নদীর তীরে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটে। প্রতিনিয়ত সেই খবরগুলো আমাদের কাছে আসছিল। আমরা দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছিলাম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর তীরে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন এক সাহসী আক্রমণ চালান। কয়েক মাইল দূর থেকে মর্টারের প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম আমরা। প্রায় ৭০০ যোদ্ধা সেই অপারেশনে অংশ নেন। সেখানেই শহিদ হন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। আমাদের বাংলার ছেলেরা সেখানে ভীষণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। পরে জানতে পারলাম, সেখানে কোনো ভারতীয় সৈন্য ছিল না। যুদ্ধ করেছে ৭ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর সাবসেক্টরের যোদ্ধারা। ১২ ডিসেম্বর তারা মহানন্দার উত্তরে পৌঁছান, তিন দিক থেকে হামলা চালান। ৯ মাসের যুদ্ধে এটি ছিল একটি অন্যতম বড় অপারেশন। শহরের ভেতরে যুদ্ধ করার মতো অস্ত্র তাদের কাছে ছিল না। তাদের সঙ্গে ছিল রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, গ্রেনেড ও হ্যান্ড গ্রেনেড।
এই অপারেশনে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। শহিদ হন প্রায় ৪০ জন মক্তিযোদ্ধা। লেফটেন্যান্ট বজলুর রশীদ ও লেফটেন্যান্ট রফিকুল ইসলাম গোমস্তাপুর চাঁপাই রোড ধরে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে শহরের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। শত্রুর অবস্থানের সঙ্গে গুলিবিনিময় চলছিল তাদের। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ডিফেন্স লাইন থেকে আক্রমণে যান। তার কোড নাম ছিল ‘টাইগার’। পাকবাহিনীর দিকে একটা গ্রেনেড চার্জ করতেই পাশের এক দালান থেকে একজন স্নাইপার তার চোখে গুলি করে। গুলিটি তার বাম চোখ থেকে ঢুকে ঘাড় থেকে বেরিয়ে যায়। লালু নামের এক যোদ্ধা একাই গুলি করতে করতে শত্রুর বাংকারে ঢুকে পড়েছিলেন। তখনই হঠাৎ শোনা যায় টাইগার নিহত।
দারুণ সাহসী মানুষ ছিলেন জাহাঙ্গীর। একদিন ব্রিফিং সেশনের সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আমরা যদি মারা যাই, আমাদের নাম কি বাংলাদেশের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে?’ জবাবে জাহাঙ্গীর বলেছিলেন, ‘আমরা আমাদের নাম সোনার অক্ষরে লিখে রাখার জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছি না। আমাদের গর্ব হওয়া উচিত যে, আমাদের রক্ত এই বাংলার মাটির সঙ্গে মিশে থাকবে। তোমরা ভাগ্যবান। কারণ তোমরা এই সময় জন্মগ্রহণ করেছ, দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করার সুযোগ পাচ্ছ।’
বাংলার ছেলেরা জীবন দিয়ে দেশটাকে বাঁচাতে চেয়েছিল। কে জানত, দুদিন পর জানা যাবে যে, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোদ্ধারা তাদের জীবন উৎসর্গ করে দিচ্ছিল, আর ওই সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করবে পাকবাহিনী, কে জানত? পরে আমরা সেই ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনার বিস্তারিত জেনেছি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়া কাইয়ুম খানের কাছ থেকে।
অনুলিখন: রাসেল মাহমুদ