![মুক্তিযোদ্ধাদের আক্ষেপ দূর হবে কবে](uploads/2023/12/16/1702696949.sriti-soudh.jpg)
স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরে নানা সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বহাল থাকায় বাংলাদেশ মানবিক সূচকে পিছিয়ে পড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৫২ বছর পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক নানা সমীকরণ কষছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আশঙ্কা, নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র আরেক দফা ধাক্কা খাবে। গতকাল শুক্রবার খবরের কাগজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বীর মুক্তিযোদ্ধারা এমন মন্তব্য করেন।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলার ইতিহাসের যে স্বাভাবিক যাত্রা শুরু হয়েছিল, তিন বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে সে যাত্রাপথ রুদ্ধ হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর ও পরে আরও ৫ বছর- মোট ২৬ বছরে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ বিরোধীদের দ্বারা দেশ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। আজ আমরা আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করছি, সমাজের মনোজাগতিক অবস্থানে এখন উগ্র সাম্প্রদায়িকতা জেঁকে বসেছে। এটি অত্যন্ত আতঙ্কের বিষয়। সামাজিক সূচকে, অর্থনীতিতে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেলেও মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন যদি পূরণ না করতে পারি, তবে মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন বৃথা যাবে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক শক্তিকে যৌথভাবে এ নিয়ে কাজ করতে হবে।’
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সহসভাপতি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী সিকদার বলেন, ‘দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম শেষে আমরা একটি গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক অর্জন করেছিলাম, সেটি হলো বাঙালি সংস্কৃতি। ঐতিহাসিক ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন আর একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের তরুণদের মনোজগতে সেই বিষয়টিই প্রভাব ফেলেছিল। তবে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ ধাক্কা খায়, যখন দেখি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী শক্তি এখনো স্বাধীনতার ৫২ বছর পর প্রবলপ্রতাপে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। তারা আমাদের জাতির পিতাকে মানে না, তারা জয় বাংলা স্লোগান মানে না। তাদের রাজনীতি বহাল থাকায় ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিকে দিকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় এখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন নষ্ট হতে চলেছে।’
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমরা একাত্তরের চেতনা ধরে রাখতে পারিনি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরিরা সংবিধান কাটাছেঁড়া করে যে পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি শুরু করেছিল, তাদের প্রভাব বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তারা যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শুরু করেছিল, এখন দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও সেই রাজনীতি করছেন। এতে মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যায়।’
সরকার এ বছর মহান মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ালেও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি এখনো থমকে আছে। এরই মধ্যে জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে নভেম্বর মাসের ভাতা পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
বীর উত্তম আব্দুস সাত্তার খবরের কাগজকে বলেন, ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে পাই। কিন্তু গত মাসে আমি ভাতা পাইনি। আমার জানামতে, আরও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা গত মাসে ভাতা পাননি।’
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে মোহাম্মদ আলী সিকদার বলেন, ‘একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা যে সম্মানী পান, যে সুবিধা পান তার চেয়েও বহু গুণ সুবিধা পান প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারা। জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধারা কী সর্বোচ্চ সম্মান পেতে পারেন না?’
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে যারা স্বজন হারিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষই রাজাকার-আলবদরের নাম বলতে পারবে না। আমরা এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি বারবার। আইনমন্ত্রী গত ৯ বছর ধরে মুলা ঝুলিয়ে রেখেছেন। তিনি বলছেন, আইনের একটি খসড়া হয়েছে। সেই খসড়া চূড়ান্ত হলে জামায়াতকে সাংগঠনিকভাবে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।’
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের আগে একাত্তরের ঘাতক দালালদের তালিকা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করা গেলে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথও সুগম হবে। তবে এই তালিকা প্রণয়নের কাজটি সরকারি কর্মকর্তাদের স্থলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের কাছে অর্পণ করার দাবি জানান তিনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মহান বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সিপিবির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মনজুরুল আহসান খানের সঙ্গে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশ নানাভাবে এগিয়ে গেলেও দুর্নীতি এখন চরম আকার ধারণ করেছে। পাকিস্তান আমলে আমরা বলতাম ২২ পরিবার কোটিপতি হয়েছে। এখন হাজারও পরিবার শতকোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে, মানুষের অভাবের শেষ নেই। পোশাকশ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি আন্দোলনে চারজন শ্রমিক মারা গেলেন। এরই মধ্যে সরকার একতরফাভাবে নির্বাচনের আয়োজন করতে যাচ্ছে। দেশে আজ নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। এতে যে রাজনৈতিকসংকট তৈরি হলো তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন। এ পরিস্থিতিতে নানা রকম ষড়যন্ত্র হবে দেশ নিয়ে, নামে-বেনামে নানা কৌশলে ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা শুরু হবে।’
স্বাধীন বাংলাদেশে চাকসুর প্রথম ভিপি বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুজ্জামান হীরা বলেন, ‘মানুষের ভোটাধিকার গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেই ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে মানুষের মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার নিষিদ্ধ করে নির্বাহী অদেশ জারি করেছে। সরকার আমাদের একাত্তরের রাজাকার-আলবদরের জুলুমের কথা মনে করিয়ে দেয়। এমন দেশের জন্য আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধ করিনি। দেশের মানুষ স্বৈরাচারী গণবিরোধী সন্ত্রাস প্রতিরোধ করেই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে।’