![জয়পুরহাট হানাদারমুক্ত হয় ১৪ ডিসেম্বর](uploads/2023/12/14/1702533680.pagla-deewan.jpg)
আজ ১৪ ডিসেম্বর। জয়পুরহাট হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে জয়পুরহাট স্বাধীন করেন।
পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল বগুড়ার সান্তাহার থেকে ট্রেনে পাঁচবিবিতে এসে প্রথমেই থানা দখলে নিয়ে গোহাটিতে হামলা চালায়। সেখানে তরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অনেক নিরীহ মানুষকে হতাহত করে।
পরদিন পাকিস্তানি সেনারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে এক দল জয়পুরহাট সদর উপজেলার পাগলা দেওয়ান এলাকায় এবং আরেক দল ক্ষেতলাল উপজেলার চরবাখড়া ব্রিজ এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর ২৪ এপ্রিল হানা দেয় গরিয়াকান্ত এলাকায়। ২৬ এপ্রিল কড়ই কাদিপুরে এ দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় ৩৭১ জন নিরীহ সংখ্যালঘু মৃৎশিল্পীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে ও বায়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। একই দিনে তাণ্ডব চালায় আক্কেলপুরের ভদ্রকালী গ্রামে।
১৮ জুন পাগলা দেওয়ান গ্রামে জুমার নামাজ শেষে বিভিন্ন গ্রাম থেকে পাকিস্তানি সেনারা কয়েকশ মানুষকে ধরে নিয়ে গলা কেটে পুঁতে রাখে। আক্কেলপুরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শহীদ খোকনসহ ২২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে তারা হত্যা করে।
শুধু তাই নয়, শত শত নারীর ইজ্জত কেড়ে তাদের উলঙ্গ করে উল্লাস করে তারা।
জেলার ৫২টি বধ্যভূমিতে অন্তত ১৫ হাজার শরণার্থী ও নিরীহ মানুষকে নৃশংশভাবে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমিতেই হত্যা করা হয় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষকে। পাগলা দেওয়ানে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যবহৃত অক্ষত একটি বাঙ্কার আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। এখনো এর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ ৭১-এর দুঃসহ স্মৃতি মনে করে শিহরে ওঠেন।
এদিকে স্থানীয় রাজাকার আব্দুল আলিমের নেতৃত্বে শহরলাল বাজলার গদিঘরে নির্মিত টর্চারসেলে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো।
৯ মাসের সশস্ত্র লড়াই-সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাঘা বাবলুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের ভূঁইডোবা সীমান্ত দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। এরপর তারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে একটি দল নিয়ে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালেব পাঁচবিবি উপজেলা সদরে পৌঁছে পুলিশ স্টেশনে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে এ উপজেলাকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করেন। অপর দলটি বিকেলে জয়পুরহাট শহরে পৌঁছে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ও সম্মুখ আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা বগুড়া ও ঘোড়াঘাটের দিকে পালিয়ে যায়।
পরে ভোরের আলো ফোটার আগেই ফাঁকা গুলি বর্ষণ করতে করতে উল্লাসের মধ্য দিয়ে শত শত মুক্তিযোদ্ধা জয়পুরহাট শহরের ডাকবাংলোতে প্রবেশ করে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জয় বাংলা স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ডাকবাংলো প্রাঙ্গণ। সেখানে সমবেত কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খন্দকার আসাদুজ্জামান বাঘা বাবলু।
এই পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে জয়পুরহাটকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
জয়পুরহাট জেলাকে হানাদারমুক্ত করতে যে অকুতভয় সূর্য সন্তানরা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের স্মরণে জয়পুরহাট শহরের প্রাণকেন্দ্রে শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দানে নির্মাণ করা হয়েছে ৭১ ফুট উচ্চতার ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ’। সদর উপজেলার পাগলা দেওয়ান, কড়ই-কাদিপুর, আক্কেলপুর উপজেলার আমুট্ট ও পাঁচবিবি উপজেলার নন্দইল বধ্যভূমিতে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ।
এ ছাড়া জেলা প্রশাসন চত্বরে ‘মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ’ ও পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে ‘প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ ৭১’ নামের একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।
এদিকে পাঁচবিবি উপজেলার পাঁচমাথায় উত্তরবঙ্গের বৃহৎ মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘মিলেছি মায়ের ডাকে’, শহরের তিনমাথায় ‘গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা’ ও রেলস্টেশন এলাকায় ‘কৃষক মুক্তিযোদ্ধা’ ভাস্কর্য এবং আদিবাসী এলাকা নন্দাইল গ্রামে ২১ ফুট উচ্চতার দেশের প্রথম আদিবাসী ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে।
জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম সোলায়মান আলী বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাঘা বাবলুর নেতৃত্বে শহরের ডাকবাংলোতে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে জয়পুরহাট শত্রুমুক্ত হয়। যুদ্ধের সময় যারা মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছে যারা যুদ্ধ অপরাধ করেছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাদের বিচার হয়েছে। অনেকের ফাঁসি হয়েছে অনেকের জাবজ্জীবন আবার কারও আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে। স্বাধীনতার অনেক পরে হলেও কুখ্যাত রাজাকার আব্দুল আলিমের বিচার হওয়ায় কলঙ্কমুক্ত হয়েছে জয়পুরহাট।’
জয়পুরহাট সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আফসার আলী বলেন, ‘১৯৭১ সালে ঝাউলাবিড়ির ঘাট, পাগলা দেওয়ান ও আগ্রাদিগুনসহ বিভিন্ন বর্ডার এলাকায় যুদ্ধ হয়। ১৪ ডিসেম্বর এসে বাঘা বাবলুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে জয়পুরহাটকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করা হয়।’
দিবসটি উপলক্ষে ১৪ ডিসেম্বর সকাল থেকে দিনব্যাপী জয়পুরহাট সদর উপজেলার পাগলা দেওয়ান, কড়ই-কাদিপুরসহ পাঁচবিবি ও আক্কেলপুর উপজেলার বধ্যভূমিগুলোয় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে জেলা ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন।
শফিউল/পপি/অমিয়/