![শহিদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা ৫২ বছরেও পূর্ণাঙ্গ হয়নি](uploads/2023/12/14/1702526495.buddhijibi-list.jpg)
দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫২ বছরেও শহিদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা যায়নি। গত দুই বছরে দুই ধাপে মাত্র ৩৩৪ জনের তালিকা চূড়ান্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে সরকারের তরফ থেকে। আর চলতি মাসেই আরেক দফা তালিকা চূড়ান্ত করার প্রস্তুতি চলছে। তালিকা প্রণয়ন কমিটি গত কয়েক দিনে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। গতকাল বুধবার একটি উপকমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এই তালিকা পূর্ণাঙ্গ করতে আরও অনেক দিন বা বছর অপেক্ষা করতে হবে, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন শহিদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তালিকা প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য খবরের কাগজকে বলেন, কোনো কোনো সদস্য বারবার তাগিদ দিলেও কারও কারও কারণে তালিকা প্রণয়নের কাজ ধীরে এগোচ্ছে। কিন্তু যদি কোনোভাবে এই সরকার ক্ষমতায় না আসে, তবে এই তালিকার কাজ যে আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে, সেটা অনেকেই বুঝতে চান না। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ দেশে পালিত হচ্ছে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস।
এখন পর্যন্ত তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য সূত্রগুলোতে শহিদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা সম্পর্কে কোথাও উল্লেখ আছে ১ হাজার ৭০ জন। কোথাওবা ৯৮৯ জন, যাদের সবাই শিক্ষক। এলাকা হিসেবে ঢাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই প্রধান্য পেয়েছেন। তবে বিচ্ছিন্নভাবে দেশের সব এলাকায় সব প্রতিষ্ঠানেই কমবেশি তালিকা রয়েছে বলে জানা যায়। পেশা হিসেবে শিক্ষকরা বেশি হলেও অন্যান্য পেশার বুদ্ধিজীবীরাও আছেন তালিকায়।
শহিদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর ইতোমধ্যে দুই ধাপে দুটি তালিকা প্রকাশ করেছি, যা গেজেট আকারে প্রকাশ পেয়েছে। প্রথম তালিকায় ১৯১ জন ও দ্বিতীয় তালিকায় ১৪৩ জনের নাম রয়েছে। এ ছাড়া এই মাসেই যাতে আরেকটি তালিকা দেওয়া যায়, সে জন্য আমরা কাজ করছি।’
ওই সদস্য বলেন, ‘কেবল ঢাকা ঘিরেই তালিকা হচ্ছে তা নয়, আমরা সারা দেশ থেকেই তালিকা আনছি। সেগুলো অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করা হয়। আমরা চাই একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে।’
এদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অন্যান্য সূত্র অনুসারে, স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’ গঠিত হয় বেসরকারি উদ্যোগে। পরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়। ওই কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের প্রায় ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে। অন্যদিকে ২০২১ সালে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন ও যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ জহির (বীর প্রতীক), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি চৌধুরী শহীদ কাদের, নিপসমের পরিচালক অধ্যাপক ডা. বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ এবং গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের গবেষক গাজী সালাউদ্দিন। এই কমিটির আওতায় একটি উপকমিটিও আছে। কমিটি বর্তমান সরকার কর্তৃক প্রণীত ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী’ সংজ্ঞাকে মূল ধরে কাজ শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সরকার ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী’ কথাটির একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহিদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ যারা হয়েছেন, তারা শহিদ বুদ্ধিজীবী।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী বাংলাদেশের অসংখ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে তাদের নির্যাতনের পর হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে গণকবরে তাদের মরদেহ পাওয়া যায়। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর নিকটাত্মীয়রা মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে স্বজনদের মরদেহ শনাক্ত করেন। এ সময় অনেকের দেহে আঘাতের চিহ্ন, চোখ ও হাত-পা বাঁধা, কারও কারও শরীরে একাধিক গুলির চিহ্ন দেখা যায়। অনেককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যার আগে যে তাদের নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল, সে তথ্যও বের হয়ে আসে।
শহিদ বুদ্ধিজীবী তালিকা প্রণয়ন ও যাচাই-বাছাই উপকমিটির সদস্য এবং শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরীর মেয়ে অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘অবশ্যই শহিদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের কাজ আরও দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা দরকার। কিন্তু লোকবল সংকটের কারণে এটা ধীরগতিতে করতে হচ্ছে। প্রয়োজনে কমিটির কাঠামো ও পরিধি বাড়িয়ে হলেও এটা দ্রুত করার দিকে নজর দিতে হবে।’
ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, ‘কেবল ঢাকার শহিদ বুদ্ধিজীবীই নয়, আমরা সারা দেশের শহিদ বৃদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির জন্য কাজ করছি। আমরা চাই অবশ্যই একটি নিখুঁত ও নির্ভুল তালিকা করতে; যেখানে একটিও সঠিক নাম বাদ থাকবে না কিংবা একটি ভুয়া নামও যুক্ত হবে না।’
এদিকে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সাময়িকী নিউজ উইকের সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের রচিত নিবন্ধে শহিদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন উল্লেখ করা হয়েছে।
সূত্র অনুসারে, ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। কোনো কোনো পত্রিকার তথ্য অনুসারে, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনাটি হয়েছিল আগেই। এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্রসংগঠন ছাত্রসংঘ মাঠপর্যায়ে হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন করে। এসব হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি জড়িত পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। তার সঙ্গে ছিলেন ব্রি. জে. আসলাম, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্নেল তাজ, কর্নেল তাহের, উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, ড. মোহর আলী, আলবদরের এ বি এম খালেক মজুমদার, আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাইনুদ্দিন; আর তাদের নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।
বুদ্ধিজীবী দিবসে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি
১৪ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। সকাল ৭টায় মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করবে আওয়ামী লীগ।
সকাল সাড়ে ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে এবং সাড়ে ৮টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বেলা ৩টায় আলোচনা সভার আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর সর্বস্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।