![‘এখানে মিশে আছে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের রক্ত’](uploads/2023/12/14/1702525445.Rayerbazar-boddhobhumi.jpg)
রায়েরবাজার বধ্যভূমির সিঁড়িতে পা ফেললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শিক্ষক, ডাক্তার, সাহিত্যিক, নাট্যকার, সাংবাদিকসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীর মায়ামাখা মুখ।
নিশ্চিত পরাজয় জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করে। একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে একেবারে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে তারা এ দেশের শিক্ষক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সরকারি কর্মকর্তাসহ বহু মানুষকে হত্যা করে। বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়।
শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। যে স্থানটিতে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, সেখানেই এই স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, শহীদুল্লা কায়সার, আলতাফ মাহমুদসহ অনেকে।
মুক্তিযুদ্ধের পর এই অঞ্চল পরিণত হয় শ্মশানে। গা ছমছমে একটা পরিবেশ বিরাজ করত এখানে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভীষিকাময় চিত্র যখন একে একে উন্মুক্ত হতে থাকল, আতঙ্ক আর ভয়ে গা কাঁটা দিয়ে উঠত রাজধানীবাসীর। রায়েরবাজারের বধ্যভূমির চারদিকে পাওয়া যেত মানুষের মাথার খুলি আর হাড়গোড়। এরপর ধীরে ধীরে পাল্টে গেছে সেখানকার জনজীবনের চিত্র। পাল্টে গেছে রায়েরবাজারও। মুক্তিযুদ্ধের সেই ইতিহাস সংরক্ষণ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এখানে নির্মাণ করা হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় স্মৃতিসৌধ।
১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সরকার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার স্থানে স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকটস যৌথভাবে স্মৃতিসৌধের নকশা প্রণয়নের জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা আহ্বান করে। ২২টি নকশার মধ্যে স্থপতি ফরিদউদ্দীন আহমেদ ও স্থপতি জামি-আল-শফি প্রণীত নকশাটি নির্বাচিত হয়। গণপূর্ত বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। কাজটি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিন বছর সময়ে সম্পন্ন হয়। ৩ দশমিক ৫১ একর আয়তনবিশিষ্ট স্মৃতিসৌধটি ১৫ দশমিক ২৪ মিটার বর্গাকার একটি গ্রিড দ্বারা ভাগ করা হয়েছে।
মূল বেদিটি ২ দশমিক ৪৪ মিটার উঁচু। স্মৃতিসৌধের প্রধান অংশটি ১৭ দশমিক ৬৮ মিটার উঁচু, শূন্য দশমিক ৯১ মিটার পুরু ও ১১৫ দশমিক ৮২ মিটার দীর্ঘ ইটের তৈরি বাঁকানো দেয়াল। এটি রায়েরবাজারের আদি ইটখোলার প্রতীক, যেখানে বুদ্ধিজীবীদের মরদেহ পড়ে ছিল। দেয়ালটির দুই দিক ভাঙা। এই ভগ্ন দেয়াল ঘটনার দুঃখ ও শোকের গভীরতা নির্দেশ করছে। দেয়ালের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে একটি ৬ দশমিক ১০ মিটার বর্গায়তনের জানালা আছে। এই জানালা দিয়ে পেছনের আকাশ দেখা যায়, যেটা বাংলাদেশের মুক্তির কথা বলে। বাঁকা দেয়ালের সম্মুখভাগে একটি স্থির জলাধার আছে। জলাধারের ভেতর থেকে কালো গ্রানাইট পাথরের একটি স্তম্ভ উঠে এসেছে শোকের প্রতীক হয়ে।
রায়েরবাজার বধ্যভূমি শুধু স্মৃতিসৌধই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস, সেই সঙ্গে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ঘ্রাণ, বিজয়ের মাসে আমরা শহিদদের স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায়।