ছাত্রদলের ২৫৭ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণার পর থেকেই সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ভেতর-বাইরে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
অভিযোগ উঠেছে, দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়, চাকরিজীবী, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের ‘বন্ধু কোটা’য় অছাত্র এবং বিতর্কিতদের কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে।
পদায়নের ক্ষেত্রে মানা হয়নি সিনিয়র-জুনিয়র চেইন অব কমান্ড। কমিটিতে ঢাকার বাইরে থেকে কারও ঠাঁই হয়নি। পক্ষান্তরে মামলায় জর্জরিত এবং পরীক্ষিত প্রায় অর্ধশতাধিক নেতাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে বিতর্কিত এসব নেতার একটি তালিকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও দপ্তরে জমা দিয়েছেন পদবঞ্চিত ছাত্রনেতারা।
সংগঠনের অন্তত আটজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ছাত্রদলের ঘোষিত কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৯০ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ জন। ঢাবিতে ৯০ জনের বাইরেও নেতা-কর্মী নেই বললেই চলে। কমিটিতে ২১ জন নারী থাকলেও শুধু ঢাবির ছাত্রী মাত্র একজন।
তিনি হলেন যুগ্ম আহ্বায়ক মানসুরা আলম। কেউ কেউ রাজপথে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলেও তাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। আবার কেউ অতিমূল্যায়িত হয়েছেন। পদায়নের ক্ষেত্রে সিনিয়র-জুনিয়র না মানায় চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার শঙ্কাও রয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিচার-বিবেচনা করেই যথার্থ কমিটি দিয়েছে হাইকমান্ড। একটা পরিবারের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ থাকতে পারে, তা নিরসনও করবেন নেতারা।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ছাত্রদলের আংশিক কমিটি দেওয়া হয়েছে। এখনো ঢাকার বাইরের নেতাদের যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে।’
ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব খবরের কাগজকে বলেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা বিভিন্ন জনকে দিয়ে এসব অভিযোগ করাচ্ছেন। যারা অভিযোগ করছেন, সবাই আমাদের রাজনৈতিক সহকর্মী।’
জানা গেছে, ছাত্রদলের কমিটি গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, যুবদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদস্যসচিব রবিউল ইসলাম নয়ন ও শীর্ষ দুই নেতার। এদের মধ্যে যুবদল নেতা হয়েও ছাত্রদল অনেকটাই নয়নের নিয়ন্ত্রণে; যা নিয়ে নেতাদের মাঝে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির ৭ নম্বর সহসভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। ওই কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন ২ নম্বর সহসভাপতি এ বি এম ইজাজুল কবির রুয়েল। ঠিক একইভাবে ঢাবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলামকে ৪ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। ওই কমিটির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুমিনুল ইসলাম জিসানকে ১ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সোহেল ও আরিফুলের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে অবমূল্যায়নের কারণে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়েছেন সহসাধারণ সম্পাদক আরিবা নিশি। সম্প্রতি পদবঞ্চিত ছাত্রদলের নেতাদের গ্রেপ্তারের পেছনেও সংগঠনের নেতাদের ইন্ধন রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
কমিটিতে নিষ্ক্রিয়, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও বিতর্কিত একাধিক নেতা
ছাত্রদলের আট নেতার দেওয়া তথ্যমতে, ছাত্রদলের কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়া মির্জা মারুফ বর্তমানে ইউসিবি ব্যাংকের কর্মকর্তা। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান তাজ, সহসাংগঠনিক সম্পাদক নরুজ্জামান রাসেল- দুজনই ঠিকাদার ব্যবসায়ী। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসনাইন নাহিয়ান ওরফে সজীব কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং সহসভাপতি আপেল মাহমুদ বিএনপির মিডিয়া সেলের ৩৫ হাজার টাকায় বেতনভুক্ত কর্মী। এ দুজনের জন্য তদবির করেছেন মিডিয়া সেলের সদস্য আতিকুর রহমান রুম্মন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. নূরে আলম একজন ব্যবসায়ী। সহসাংগঠনিক সম্পাদক নাইমুল হোসেন রোমান ও হুমায়ূন কবির নয়ন- দুজনই বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। সহসভাপতি জকির উদ্দিন আবিরের নামে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে।
সহসভাপতি আনোয়ার পারভেজ ও হাবিবুল বাশার- তারা শিক্ষকতা পেশায় রয়েছেন। সহসভাপতি মো. জহিরুল ইসলাম দিপু পাটোয়ারী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানজিয়া আফরিন এলিনা, সহসাধারণ সম্পাদক মো. রাহাত হোসেন দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোবারক হোসেন চাঁদপুর মতলব উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো. শামীম শেখ শেরেবাংলা নগর থানার স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য, সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমবিষয়ক সম্পাদক আহমেদ কামরান রাশেদ সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। রাশেদের হয়ে লবিং করেছেন বিএনপির তথ্যপ্রযুক্তি সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান অ্যাপোলো।
সহসভাপতি মো. জুয়েল মৃধা ও আশরাফুল ইসলাম রবিন- দুই নেতার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জুয়েলের বয়স ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে। রবিনের এসএসসি সার্টিফিকেট নেই। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকরি করেন। যদিও ছাত্রদল বলছে, ভুল করে জুয়েল রানা বলা হচ্ছে, এটা হবে জুয়েল হোসেন।
সহসভাপতি জুয়েল মৃধা খবরের কাগজকে বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুয়া। তিনি ২০০৬-০৭ অনার্স ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং এসএসসি দিয়েছেন ২০০৩ সালে। তার নামে ২৬টি মামলা রয়েছে ও সাজাও হয়েছে। তার দাবি, আন্দোলনে তার মতো কেউ বেশি রাজপথে ছিল না।’
আর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. নূরে আলম বলেন, ‘যারা মাঠে ছিলেন না তারা এসব গুজব রটাচ্ছেন।’ হাসনাইন নাহিয়ান সজীব নামে আরেকজন খবরের কাগজকে বলেন, ‘২০২১ সালে যুবদলের কমিটিতে তার নাম ভুলক্রমে চলে আসে। পরে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।’
কমিটিতে অতিমূল্যায়িত হয়েছেন সহসাধারণ সম্পাদক জুবাইদা ইসলাম জেরিন ও জান্নাতুন নওরীন উর্মি। এ ছাড়া আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে চাকরি করার ও দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ রয়েছে।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ‘বন্ধু কোটা’
সংগঠনের একাধিক নেতা-কর্মীর অভিযোগ, ছাত্রদলের সভাপতি রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছিরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় ‘বন্ধু কোটায়’ কয়েকজনকে পদায়ন হয়েছে। এরা হলেন সভাপতির বন্ধু সহসভাপতি অলিউজ্জামান সোহেল ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রাব্বি হাসান। সাধারণ সম্পাদকের বন্ধু যুগ্ম সাধারণ ওমর ফারুক শাকিল চৌধুরী, সহসাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জামান তুফান। শাকিলের বনশ্রীতে মুদি দোকান রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন।
ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. শিপন বিশ্বাস খবরের কাগজকে বলেন, ‘এত বড় কমিটি। আরও যাচাই-বাছাই করে নেতা সিলেক্টের প্রয়োজন ছিল। হামলা-মামলায় জর্জরিত এবং পরীক্ষিতদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ২৮ অক্টোবরের পর যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন তারা এই কমিটিতে কীভাবে স্থান পেলেন?’
জানা গেছে, বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্দিষ্ট দুটি বলয় থেকে নেতা হয়েছেন। ‘পকেট কমিটি’ ‘মাইম্যান’ বলয়ের বাইরেও কাউকে কমিটি রাখা হয়নি। শীর্ষ দুই পদসহ নীতিনির্ধারণী ফোরামের ৩১ জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্যদের ভূমিকা রাখতে পারবে না। নেতাদের বয়সও ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। বেশির ভাগই পড়াশোনায় অনিয়মিত। কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মিত কোর্সে ভর্তি আছেন। নারীদের মধ্যেও অনেকেই অনিয়মিত কিংবা ‘ড্রপ আউট’ শিক্ষার্থী।
আক্ষেপ করে নেতা-কর্মীরা বলেন, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়- মোটাদাগে ঢাকার বাইরে কাউকে রাখা হয়নি। অথচ সারা দেশের ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা হামলা-মামলা-নির্যাতনের শিকার হন বেশি। বিগত আন্দোলনে ঢাবির অবদান কী? একসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি রুহুল কবির রিজভী ছাত্রদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে অনেকেই ছাত্ররাজনীতি ছেড়ে দেবেন।
এসব অভিযোগের জবাবে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, ‘২৫০ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা শতভাগ যাচাই-বাছাই করে কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে। যারা অভিযোগ করছেন, তাদের কাছেও সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ নেই। গত বছরের ২৮ অক্টোবরের পর থেকে যারা রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন, তাদের দালিলিক প্রমাণসহ কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে। ঢালাওভাবে অভিযোগ করা হচ্ছে, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।’
তিনি বলেন, ‘যারা কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন, তাদের আগামীতে আংশিক কমিটির আকার বাড়ালে সক্রিয়তা দেখে পদায়ন করা হবে। ঢাকার বাইরে থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’
ঢাবিতে কমছে নেতা-নেত্রী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর ‘হল কমিটি’ দেওয়ার জন্য নেতৃত্ব-সংকটে ভুগছে ছাত্রদল। ছেলেদের হল কমিটি দিতে নেতা পেলেও নারীনেত্রী খুঁজে পাচ্ছে না সংগঠনটি। কারণ হিসেবে নেতা-কর্মীরা বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ঢুকতে দিচ্ছে না। ফলে নতুন কর্মী সংগ্রহের সুযোগ কম এবং নতুন কর্মীও তৈরি করতে পারছে না ছাত্রদল। এ ছাড়া ছাত্রলীগের হামলা-মামলা এবং ক্যাম্পাস ছাড়ার ভয়ে অনেকেই ছাত্রদল করলেও তারা পদ-পদবি নিতে চান না।