ভ্রমণ শুরু করার আগে যেসব সুন্নত ও আদব জেনে রাখা উচিত, সেগুলো হলো—
হালাল পাথেয়র ব্যবস্থা করা: সফরে যাওয়ার আগে পরিবারের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি সফরের জন্য হালাল পাথেয়র ব্যবস্থা করা। কারণ হালাল রুজি ছাড়া কোনো ভালো কাজই আল্লাহতায়ালা কবুল করেন না। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা পবিত্র, তিনি পবিত্র জিনিস ছাড়া কবুল করেন না।’ আল্লাহতায়ালা আরও এরশাদ করেছেন, ‘হে রাসুলগণ, পবিত্র বস্তু আহার করো এবং নেক আমল করো।’ (সুরা মুমিন, আয়াত: ৫১)
দেনা-পাওনা ও অসিয়ত লিখে রাখা: সফরে বের হওয়ার আগে দেনা-পাওনার হিসাব এবং অসিয়ত থাকলে লিখে রাখা উচিত। কারণ কোনো মানুষই জানে না, সে কোথায়, কখন মারা যাবে। (সুরা লোকমান, আয়াত: ৩৪)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম ব্যক্তির উচিত নয় যে, তার কাছে অসিয়তযোগ্য কিছু (সম্পদ) থাকাবস্থায় সে দুই রাত কাটাবে অথচ তার কাছে অসিয়ত লিখিত থাকবে না।’ (বুখারি, ২৭৩৮)
সম্ভব হলে স্ত্রী সঙ্গে নেওয়া: দীর্ঘদিনের উদ্দেশ্যে সফরকালে সম্ভব হলে ও ব্যবস্থা থাকলে স্ত্রীকে সঙ্গে নেওয়া উচিত। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সফরে যাওয়ার মনস্থ করলে স্ত্রীদের মধ্যে লটারি করতেন। যার নাম আসত তিনি তাঁকে নিয়েই সফরে যেতেন। (বুখারি, ২৫৯৩) তবে হজের সফরে তিনি সব স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। (জাদুল মাআদ, ১/৪৪৫)
উপদেশ গ্রহণ করা: সফরে বের হওয়ার আগে সফরের স্থান সম্পর্কে অভিজ্ঞ অথবা সৎ ও পুণ্যবান ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করা উচিত। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমি সফরে যাওয়ার ইচ্ছা করেছি, অতএব আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বলেন, অবশ্যই তুমি আল্লাহভীতি (তাকওয়া) অবলম্বন করবে এবং প্রতিটি উঁচু স্থানে ওঠার সময় তাকবির (আল্লাহ আকবার) ধ্বনি দেবে। লোকটি যখন চলে যাচ্ছিল, এমন সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আল্লাহ, তার পথের ব্যবধান কমিয়ে দাও এবং তার জন্য সফর সহজতর করে দাও।’ (তিরমিজি, ৩৪৪৫)
সম্ভব হলে বৃহস্পতিবার সফর শুরু করা: সম্ভব হলে বৃহস্পতিবার সফরে বের হওয়া বা সফর শুরু করা উত্তম। কাব বিন মালেক (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) তাবুক অভিযানে বৃহস্পতিবারে বের হলেন। আর তিনি বৃহস্পতিবার (সফরে) বের হওয়া পছন্দ করতেন।’ (বুখারি, ২৯৪৯)
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃহস্পতিবার ছাড়া অন্য দিনে কমই সফরে বের হতেন।’ (বুখারি, ২৯৪৯)
দিনের প্রথম অংশে বা রাতে সফর শুরু করা: অন্যান্য কাজের মতো সকাল সকাল সফরে বের হওয়াও সফরের অন্যতম আদব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমার উম্মতের জন্য তাদের সকালে বরকত দাও। আর তিনি যখন ছোট-বড় কোনো অভিযানে সেনাবাহিনী পাঠাতেন, তখন তাদের সকালে পাঠাতেন। (আবু দাউদ, ২৬০৬)। সম্ভব হলে রাতের বেলায় সফর করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের ফজরের আগে অন্ধকার অবস্থায় সফর করা উচিত। কারণ রাতের বেলা জমিন সংকুচিত হয়।’ (আবু দাউদ, ২৫৭১)
ভ্রমণকালে পালনীয় কিছু সুন্নত ও আদব রয়েছে, সেগুলো হলো—
ভ্রমণের শুরুতে দোয়া পাঠ করা: আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সফরে বের হওয়ার সময় উটের ওপর ধীরস্থিরতার সঙ্গে বসার পর তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন। এই দোয়াটি পাঠ করতেন, বাংলা উচ্চারণ: সুবহানাল্লাজি সাখখার লানা হাজা ওয়ামা কুন্না লাহু মুকরিনিনা ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লা মুনকালিবুন। বাংলা অর্থ: ‘মহা পবিত্র সেই সত্তা, যিনি একে আমাদের জন্য (বাহনকে) অনুগত করে দিয়েছেন। অথচ আমরা একে বশীভূত করতে সক্ষম ছিলাম না। আর আমরা আমাদের প্রতিপালকের কাছে অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব।’ (মুসলিম, ১৩৪২)
সৎ বা ভালো লোকের সঙ্গী হয়ে সফর করা: সফরে ভালো সঙ্গী থাকা জরুরি। কারণ সঙ্গী-সাথির প্রভাবে মানুষ ভালো-মন্দের দিকে ধাবিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) সৎ সঙ্গীকে সুগন্ধির সঙ্গে তুলনা করেছেন। যার সঙ্গে থাকলে সুগন্ধি পাওয়া যায়। আর অসৎ সঙ্গীকে কামারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যার সঙ্গে থাকলে কাপড় জ্বালিয়ে দেবে অথবা দুর্গন্ধ পাওয়া যাবে। (বুখারি, ৫৫৩৪)
একাকী সফর না করা: সফরকালে একাকী না গিয়ে তিনজন বা তার বেশি লোকের সঙ্গে সফর করা উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘একাকী সফরকারী হচ্ছে একটি শয়তান, আর একত্রে দুজন সফরকারী দুটি শয়তান। তবে একত্রে তিনজন সফরকারীই হচ্ছে প্রকৃত কাফেলা।’ (আবু দাউদ, ২৬০৭)
আমির বানানো: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তি একত্রে সফর করলে তারা যেন নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে আমির বানায়।’ (আবু দাউদ, ২৬০৮)
একত্রিত থাকা: আবু সালাবা আল-খুশানি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর লোকজন যখন কোনো স্থানে (বিশ্রামের জন্য) নামতেন, তখন তারা বিভিন্ন গিরিপথে ও উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়তেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের বলতেন, ‘এসব গিরিপথে ও পাহাড়ি উপত্যকায় তোমাদের বিভক্ত হয়ে পড়াটা শয়তানের ষড়যন্ত্র।’ (আবু দাউদ, ২৬২৮)
তাসবিহ পাঠ করা: সফরে বা অন্য যেকোনো সময় উঁচু স্থানে উঠতে ‘আল্লাহু আকবার’ এবং নিচে নামতে ‘সুবহানাল্লাহ’ বলা। (বুখারি, ২৯৯৩)
বেশি বেশি দোয়া করা: সফর অবস্থায় দোয়া কবুল হয়। তাই সফর অবস্থায় বেশি বেশি দোয়া করা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়। ১. পিতা-মাতার দোয়া, ২. মুসাফিরের দোয়া, ৩. মজলুমের দোয়া।’ (আবু দাউদ, ১৫৩৬)
সফরে কুকুর বা ঘণ্টা না রাখা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ফেরেশতারা ওই সফরকারী দলের সঙ্গে অবস্থান করেন না, যাতে কোনো কুকুর বা ঘণ্টা থাকে।’ (মুসলিম, ৫৪৩৯)
সঙ্গী-সাথীদের সাহায্য করা: আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘একবার আমরা কোনো সফরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এ সময় এক ব্যক্তি সওয়ারিতে আরোহণ করে আগমন করল। অতঃপর সে তার দৃষ্টি ডানে-বামে ফিরানো শুরু করল। তা দেখে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘যার কাছে অতিরিক্ত সওয়ারি আছে; সে যেন তা তার জন্য নিয়ে আসে যার সাওয়ারি নেই। আর যার কাছে নিজের পাথেয়র অতিরিক্ত পাথেয় আছে; সে যেন তার জন্য তা নিয়ে আসে, যার পাথেয় নেই।’ (মুসলিম, ১৭২৮)
পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা: সফরে সব ধরনের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৭)
মাহরাম ছাড়া নারীদের একাকী সফর না করা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নারীরা মাহরাম (যার সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ) ছাড়া সফর করবে না। মাহরাম ছাড়া কোনো পুরুষ কোনো নারীর কাছে গমন করতে পারবে না।’ (বুখারি, ১৮৬২)
অপচয় না করা: সফর অপচয় যেন না হয় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে। (সুরা ইসর, আয়াত: ২৭)
আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানে সফর না করা: আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির এলাকায় যথাসম্ভব প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একান্ত প্রবেশ করতে হলে কান্নারত অবস্থায় প্রবেশ করবে। (বুখারি, ৪৩৩)
নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছার পর দোয়া পড়া: খাওলাহ বিনতু হাকিম (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কোনো স্থানে অবতরণ করে যে এই দোয়াটি পাঠ করবে; ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কোনো জিনিস তার অনিষ্ট করতে পারবে না। দোয়াটি হলো, বাংলা উচ্চারণ: আউজু বিকালিমাতিল্লাহিত তামমাতি মিন শাররি মা খালাক। বাংলা অর্থ: আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমাসমূহের মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টি সকল কিছুর অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় চাই।’ (মুসলিম, ২৭০৮)
যানবাহনের ওপর নামাজ আদায় করা: সফর অবস্থায় যানবাহনে নামাজ আদায় করার সুযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় ইশারায় রুকু ও সিজদা করতে হবে। রুকু থেকে সিজদায় মাথা তুলনামূলক একটু বেশি ঝুঁকাতে হবে। ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সফরে ফরজ নামাজ ছাড়া তাঁর সওয়ারিতেই ইশারায় রাতের নামাজ আদায় করতেন; সওয়ারি যে দিকেই ফিরুক না কেন। এ ছাড়া তিনি বাহনের ওপরেই বিতর আদায় করতেন।’ (বুখারি, ১০০০)
ভ্রমণ থেকে ফেরার সময়ের সুন্নত ও আদবগুলো হলো—
যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পরিবারের কাছে ফেরা: সফর হলো কষ্টের স্থান। তাই সফরের কাজ শেষ হলে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পরিবারের কাছে ফিরে আসা উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সফর আজাবের অংশবিশেষ। যথাসময়ে পানাহার ও নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায়। কাজেই সে যেন নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে যত দ্রুত সম্ভব আপনজনের কাছে ফিরে যায়।’ (বুখারি, ১৮০৪)
হঠাৎ করে রাতে বাড়িতে প্রবেশ না করা: দীর্ঘ সফর থেকে ফিরে হঠাৎ করে বা কোনো প্রকার অবহিতকরণ ছাড়া রাতে বাড়িতে প্রবেশ করতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিষেধ করেছেন। আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রাতে কখনো (সফর থেকে ফিরে) পরিবারের কাছে প্রবেশ করতেন না। তিনি প্রভাতে কিংবা বিকাল ছাড়া পরিবারের কাছে প্রবেশ করতেন না।’ (বুখারি, ১৮০০)
নামাজ আদায় করা: কাব বিন মালিক (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সফর থেকে ফিরে এসে প্রথমে মসজিদে প্রবেশ করে নামাজ আদায় করতেন।’ (বুখারি, ৪৪৩)
অভ্যর্থনা জানাতে এলে তাকে সম্মান করা: সফরকারীকে কেউ অভ্যর্থনা জানাতে এলে আগত ব্যক্তিকে সম্মান করা উচিত। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কায় এলে আব্দুল মুত্তালিব গোত্রীয় কয়েকজন তরুণ তাঁকে স্বাগত জানায়। তিনি অভ্যর্থনাকারীদের একজনকে তাঁর সওয়ারির সামনে ও অন্যজনকে পিছনে তুলে নেন।’ (বুখারি, ৭৯৮)
পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য কিছু নিয়ে আসা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর হাদিয়া দাও, তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।’ (বায়হাকি, ৬/১৬৯)
সফর থেকে ফিরে দোয়া পাঠ করা: আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) সফর থেকে ফিরে এসে এ দোয়াটি পড়তেন। দোয়াটি হলো, বাংলা উচ্চারণ: আয়িবুনা তায়িবুনা আবিদুনা লিরব্বিনা হামিদুন। বাংলা অর্থ: আমরা প্রত্যাবর্তন করলাম তওবাকারী, ইবাদতকারী এবং আমাদের মহান রবের প্রশংসাকারী হিসেবে। (মুসলিম, ১৩৪২)
লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক