![নতুন বছরে বিপাকে ভাড়াটিয়া](uploads/2024/01/10/1704902354.buildings.jpg)
জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। ব্যয় জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনেকে বাধ্য হয়ে নিয়মিত খাবারের তালিকা থেকে মাছ, মাংস, ডিম, দুধের মতো খাবার কাটছাঁট করছেন। এরই মধ্যে বেশির ভাগ বাড়ির মালিক নতুন বছরের শুরুতেই ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছেন। বাড়তি ভাড়া জোগাড়ের চিন্তায় দিশেহারা ভাড়াটিয়া, অনেকে নতুন বাসার খোঁজে নেমেছেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর খবরের কাগজকে বলেন, বাড়িওয়ালাদের বেশির ভাগই সমাজের প্রভাবশালী ধনী মানুষ। তারা বিবেচনাহীনভাবে ভাড়া বাড়ানোর পাশাপাশি ভাড়া কম দেখিয়ে করও ফাঁকি দেন। অনেকে ই-টিআইএন পর্যন্ত নেননি। ভাড়া আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে এর আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আইন করেছিল। কিন্তু প্রভাবশালী ভাড়াটিয়ারা এতই ক্ষমতাবান যে তাদের দাপটে সে আইন বাতিল করতে সরকার বাধ্য হয়।
বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে, ‘ভাড়া নির্ধারণে ভাড়াটিয়াদের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক। বাড়ির মালিক প্রতি দুই বছর পরপর যুক্তিগত পরিমাণে ভাড়া বাড়াতে পারবে। অগ্রিম হিসেবে এক মাসের ভাড়ার বেশি নেওয়া যাবে না। বাড়িওয়ালা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভাড়াটিয়ার কাছে ধার্য করা ভাড়ার সঙ্গে অধিক জামানত, প্রিমিয়াম অথবা কোনো সালামি গ্রহণ করতে পারবেন না।’
এ আইন সুরক্ষা দিতে পারছে না ভাড়াটিয়াদের। আমাদের দেশে বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়ার সামর্থ্য বিবেচনায় ভাড়া নির্ধারণ করেছেন, এমন নজির নেই বললেই চলে। ভাড়া কত হবে, কত দিন পর, কী পরিমাণ বাড়ানো হবে, অগ্রিম হিসাবে কত নেওয়া হবে- এসব নির্ভর করে বাড়িওয়ালার মর্জির ওপর। বাড়িওয়ালার চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তে ভাড়াটিয়ারা বিপাকে পড়লেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যাদের সামর্থ্য থাকে না, তারা তল্পিতল্পা গুটিয়ে ছোটেন অন্য ঠিকানায়। বাড়িওয়ালাদের বিবেচনাহীন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভাড়াটিয়াদের আইনি আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ থাকলেও অনেকে ঝামেলা এড়াতে এ পথে আসেন না। অনেকে আবার আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানেনই না। অনেক সাধারণ ভাড়াটিয়া প্রভাবশালী বাড়িওয়ালার ভয়ে আইনি পদক্ষেপ নেন না।
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, উচ্চবিত্তের বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর চাপ কম থাকে। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষই প্রভাবশালী। তারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নেন। ভাড়া বেশি বাড়ানো হচ্ছে নিম্ন, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়িয়ে চাপিয়ে দেন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৫ বছরে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ, বাড়ি ভাড়া বেড়েছে গড়ে ১০ শতাংশ। এর মধ্যে বস্তির ঘর ভাড়া বেড়েছে ১১ শতাংশ এবং মেস রুমের ভাড়া গড়ে ৮ শতাংশ।
মিরপুর-১০ নম্বরে মাসে ১৫ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী জুবায়ের হাসান। তিনি মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতন পান। খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, যাতায়াত খাতে বেতনের সবটা খরচ হয়। প্রায় প্রতি মাসেই পাড়ার মুদি দোকানে বাকি এবং ধারদেনাও করেন।
জুবায়ের হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বেতনের প্রায় অর্ধেক ব্যয় করি বাসা ভাড়ায়। জানুয়ারির ২ তারিখ বাড়িওয়ালা ২ হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন। চাল, ডাল, শাকসবজি, মাছ, মাংসসহ সব খাবারের দাম বেশি। দুই সন্তানের স্কুলের বেতন, ওষুধের দাম, রিকশা ভাড়াসহ প্রায় সব খরচ বেশি। প্রতি মাসেই ধারদেনা-বাকি করি। কিন্তু আমার বেতন তো বাড়েনি। বাড়তি বাসা ভাড়া কোথা থেকে দেব?’
তেজকুনি পাড়ায় ভাড়া থাকেন রাশেদ কবীর। তিনি বলেন, ‘পরিবার নিয়ে তিন বছর ধরে এই বাসায় বসবাস করছি। চারবার ভাড়া বাড়িয়েছেন বাড়িওয়ালা। এ ছাড়া ভাড়া নিয়ে কোনো চুক্তি করেন না। অসুস্থ স্ত্রী নিয়ে বাসা পাল্টানো অনেক ঝামেলার। আইনি ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ির মালিক এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার সঙ্গে আইনি ঝামেলায় গিয়ে এখানে থাকতে পারব না।’
সরেজমিনে রাজধানীর মিরপুর-১০, ১, ২, ১৩, নম্বর, মোহাম্মদপুর, ফামর্গেট, ধানমন্ডি, গুলশান, সেগুনবাগিচা, উত্তরা, টঙ্গী, জিগাতলা, শ্যামলী, বনশ্রী, শংকর এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিজাত, সাধারণ মানের, এমনকি বস্তি এলাকাতেও ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে জানুয়ারির শুরুতেই অনেক বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াদের ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছেন।
মিরপুরের-১৩ নম্বর সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করেন সুফিয়া বেগম। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘অভাবে ঢাকায় আইছি আয় করতি। বাসাবাড়িতে কাম করি ৭ হাজার ট্যাকা পাই। দুই মাস আগে মিরপুর-১০ নম্বরে বাসা নিচ্ছি। ২ হাজার ৫০০ টাকা এক ঘরের ভাড়া। অন্য ভাড়াটিয়ার লগে বাথরুম আর রান্নাঘর। গত ৫ তারিখ বাড়িওয়ালা ৩০০ টাকা ভাড়া বাড়ানোর কথা জানাইছে। কেমন কী হবে? বুঝতে পারতাছি না।’
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের অভিজাত এলাকার বাড়ির মালিকদের রাজস্ব পরিশোধের তথ্য খতিয়ে দেখতে নামেন। ২০১১ সালে এনবিআর কর্মকর্তারা ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে দুই ধাপে ছয় লাখের বেশি বাড়িওয়ালার ওপর রাজস্ব পরিশোধের তথ্য খতিয়ে দেখেন, ১ লাখ ৫ হাজারের বেশি ই-টিআইএন গ্রহণ করেননি, ই-টিআইএন থাকলেও রিটার্ন দাখিল করেননি ১ লাখ ৩২ হাজারের বেশি এবং ৯৮ হাজার হিসাবের চেয়ে কম পরিশোধ করেছেন।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, বেশির ভাগ বাড়ির মালিক ভাড়ার পরিমাণ কম দেখিয়ে কর ফাঁকি দেন। ভাড়াটিয়াকে বাড়ি ভাড়ার রসিদ দেন না। অনেকে রসিদ দিলেও কম লিখে রাখেন।
২০১১-১২ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে কঠোর আইন করা হয় যে ২৫ হাজার টাকার বেশি বাড়ি ভাড়া হলে ব্যাংকে আলাদা হিসাব খুলে আদায় করতে হবে। কিন্তু সরকারের এ আইন শেষ পর্যন্ত পাল্টাতে হয়। প্রভাবশালী বাড়িওয়ালারা এক জোট হয়ে এ আইন সংশোধনে উঠেপড়ে লাগেন। বাড়ির মালিক কিছু বড় মাপের ব্যবসায়ী, অনেক আমলা, কিছু সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীও ছিলেন এ দলে। আইনটি কার্যকরের ২১ দিন পর আইনটি সংশোধনে বাধ্য হয় এনবিআর। সংশোধনীতে বলা হয়, বাড়িওয়ালার ইচ্ছা হলে ভাড়ার টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়েও থাকতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে এনবিআর আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে না।
তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সে সময়ে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, বাড়িওয়ালারা অনেকেই প্রভাবশালী। তাই ব্যাংকের মাধ্যমে বাড়ি ভাড়া আদায়ে আইন করে বাড়ি ভাড়াওয়ালাদের ওপর নজরদারি সম্ভব হয়নি।
বাসস্থান প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। সেই বিষয়ে লক্ষ রেখে বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিকের আবাসনপ্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের এ নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালের জাতীয় গৃহায়ণ নীতিতে সাধ্যের মধ্যে সবার আবাসনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে, বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য। কিন্তু দেশের রাজধানীসহ সারা দেশে সবচেয়ে বেশি আবাসনসংকটে রয়েছে এ দুই শ্রেণির মানুষ।