![মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে আগুন](uploads/2024/03/02/1709356761.Bailey_Road.jpg)
বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) ঘড়ির কাঁটা যখন রাত ৯টা ৫০ মিনিট, ঠিক তখন রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল ভবনটিতে আগুন লাগে। ২০ মিনিট পর ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। ১৩টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ২ ঘণ্টার আগুনে গতকাল শুক্রবার (১ মার্চ) পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা যায়, ভবনটিতে মাত্র একটি সিঁড়ি ছিল। দুটি লিফ্ট ছিল। আগুন লাগার পর কেউ নামতে পারেননি। কেউ বলছিলেন ওপরে আগুন লেগেছে, কেউ বলেছেন নিচে আগুন লেগেছে। ফলে মানুষ কোন দিকে যাবেন তা বোঝা যায়নি। এ কারণে এত মানুষ মারা গেছেন।
‘ভবনটিতে একাধিক রেস্তোরাঁ ও দোকান ছিল, যার মধ্যে কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁ, স্যামসাংয়ের শোরুম, গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ার, ইলিন, খানা ও পিৎজা ইন নামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। পুরো ভবনের প্রতিটি তলায় রেস্তোরাঁ থাকায় ভবনে গ্যাস সিলিন্ডার মজুত রাখা ছিল, যার ফলে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।’
যেভাবে আগুনের সূত্রপাত
ভবনটির বিপরীত পাশে থাকা মি. বেকারের ম্যানেজার (ক্যাশ) কামরুল খবরের কাগজকে বলেন, ‘চোখের সামনে মানুষ মারা গেল, আর আমরা সবাই অসহায়ের মতো দেখলাম। ২০ মিনিটের মধ্যেই সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। রাস্তায় যানজট থাকার কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে আসতে দেরি হয়। যার কারণে হয়তো এত মানুষ মারা গেছেন। ফায়ার সার্ভিসের অভিযান শুরু করতে দেরি হওয়ার কারণও রয়েছে, এর মধ্যে বড় কারণ হলো সাধারণ মানুষ ও ফেসবুক পার্টি আগুনের ভিডিও লাইভ করতে থাকে। যে কারণে গলিতে ফায়ার সাভিসের গাড়ি ঢুকতে দেরি হয়। এ ছাড়া পর্যাপ্ত পানির অভাব ছিল ফায়ার সার্ভিসের কাছে।’
ভবনটির ডান পাশে কেএফসিতে কর্মরত ওয়েটার আহাদ জানান, ভবনটিতে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার সাধারণ মানুষ অন্যান্য মার্কেটের কাছে আসেন ফায়ার সেফটি নেওয়ার জন্য, কিন্তু কেউ সেফটি দেয়নি। বরং সেসব মার্কেট, দোকান, অফিস ও রেস্টুরেন্ট দ্রুত বন্ধ করে দেয়।
আগুন লাগা ভবনের কাচ্ছি ভাই রেস্টুরেন্টের ওপরের সাততলায় বসবাসরত সাখাওয়াত জানান, নিচতলায় কিচেন থেকে আগুন লাগে, ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর গ্যাস বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরা ভবনের আশপাশে। মানুষ বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকেন। ফায়ার সার্ভিস দ্রুত আসতে পারলে অনেক প্রাণ বেঁচে যেত।
প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কনস্টেবল আজাদ জানান, আগুন নেভাতে গিয়ে তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও আহত হয়ে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে এখন চিকিৎসাধীন।
মি. বেকারের আরেক কর্মচারী খবরের কাগজকে জানান, প্রথমে কাচ্চি ভাইয়ের নিচতলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। তবে কাচ্চি ভাইয়ের দোতলাতেও আগুন লাগে। এরপর সেখান থেকে আর কেউ বের হতে পারেননি।
জানা যায়, ভবনটিতে পিৎজা ইন, স্ট্রিট ওভেন, খানাসহ আরও রেস্টুরেন্ট ছিল। এ ছাড়া ইলিয়েন, ক্লোজেস্ট ক্লাউডসহ জনপ্রিয় বিপণিবিতানও ছিল।
আগুন লাগা ওই ভবনের কর্তৃপক্ষকে তিনবার নোটিশ দেওয়া হলেও সতর্ক হয়নি কেন?
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দুর্ঘটনাটির খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। বৃহস্পতিবার রাস্তায় একটু যানজট ছিল, সে কারণে হয়তো যথাসময়ে আসা সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের কোনো ধরনের গাফিলতি নেই।’
তিনি বলেন, ‘ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তাকে আমাদের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হলেও তিনি গাফিলতি করেছেন। এর দায়ভার তিনি এড়িয়ে যেতে পারেন না। তা ছাড়া ওই ভবনে কোনো অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ছিল না। মানুষের আসা-যাওয়ার জন্য কেবল একটি ছোট সিঁড়ি ছিল। ভবন কর্তৃপক্ষকে অগ্নিনিরাপত্তা-সংক্রান্ত নোটিশ দেওয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডে অনেক মানুষ মারা গেছেন। এই মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য নয়। ভবনটায় মাত্র একটি সিঁড়ি থাকায় ধোঁয়ার কারণে মানুষ সেখানে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি, আমরা আসলে দেখতে চাই কারও কোনো গাফিলতি আছে কি না। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
ভবনটিতে অফিস করার অনুমতি ছিল। কিন্তু অফিস না করে এখানে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টসহ দোকান করা হয়েছে- এ বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, ‘আমরা শুধু ফায়ার সেফটি প্ল্যানটা দেখি। এ বিষয়ে রাজউক বলতে পারবে। তবে এ বিষয়টি আমরাও তদন্ত করে দেখব। এই ভবনটিকে এর আগেও অগ্নিনিরাপত্তা-সংক্রান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। আমরা মনে করি, যারা ব্যবসা করেন, তাদের সবাইকে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার।’
আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল নিচতলা থেকে। আমাদের প্রাথমিকভাবে ধারণা, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।’
সূত্র জানায়, ভবনটিতে বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ ছিল এবং সিঁড়ির পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। যার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) এম খুরশীদ আলম খবরের কাগজকে বলেন, বেইলি রোডের ভবনটিতে গ্রিন কজি কটেজে প্রথমে ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্টুরেন্ট থেকে আগুন ছড়ানোর খবর পাওয়া গেলেও কাচ্চি ভাই নয়, আগুনের সূত্রপাত নিচতলার একটি দোকান থেকে হয়েছে বলে আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি।
র্যাবের ডিজি বলেন, ‘নিচের একটি ছোট দোকানে প্রথমে আগুন লেগেছিল। সেখানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে তারা প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। তবে পরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ মানুষই ধোঁয়ার কারণে শ্বাসরোধে মারা গেছেন।’
খুরশীদ আলম বলেন, ‘যে ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এখনো তদন্ত শুরু করিনি। কারা সিঁড়িতে সিলিন্ডার রেখেছে তা বের করা হবে। আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারাও রিপোর্ট দেবে। একটি ভবন তৈরির ক্ষেত্রে রাজউকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এ জন্য একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সরকার দায়িত্ব দিলে আমরা এ বিষয়ে তদন্ত করব। দায়িত্ব না পেলেও প্রকৃত ঘটনার খোঁজ নিয়ে ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের সহায়তায় একটি রিপোর্ট তৈরি করা হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলছেন, এই আগুনের ঘটনাটি কি শুধুই দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, সেটি খতিয়ে দেখতে গোয়েন্দারা মাঠে কাজ করছেন।
পুরো ভবন ছিল আবদ্ধ, দেয়ালে দেয়ালে মানুষের হাতের ছাপ
বেইলি রোডের ভবনটি ছিল আবদ্ধ। আলো-বাতাসের জায়গা ছিল না। আটকা পড়া ব্যক্তিদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিলেন তৃতীয় তলার একটি কক্ষে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও তারা বের হতে পারেননি। কক্ষ থেকে উদ্ধার হয় ৯ জনের লাশ। সেখানে থাকা সবাই ধোঁয়ায় মারা গেছেন। ধোঁয়া থেকে বাঁচতে জানালা খুঁজেছিলেন তারা। দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে তাদের হাতের ছাপ। গতকাল শুক্রবার সকালে ওই ভবন থেকে বেরিয়ে এমন বর্ণনা দেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিনের সঙ্গে তিনি ওই ভবন পরিদর্শন করেন।
আমরা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি চাই না
এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি চাই না। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি আমাদের ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডে মানুষ তাদের মূল্যবান জীবন হারাচ্ছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে অধিকাংশ ভবনে অগ্নিপ্রতিরোধক ব্যবস্থা নেই। অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিগুলো জানার পরও ভবনগুলোতে দিনের পর দিন নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এই অগ্নিকাণ্ডে অবশ্যই অসচেতনতা ছিল, অবহেলা ছিল। এত বড় একটি বাণিজ্যিক ভবনে ফায়ার এক্সিট থাকবে না? আর এটি না থাকার কারণে মানুষ অনেক চেষ্টা করেও বের হতে পারেনি।’
গতকাল শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
কমিশনের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি মর্মপীড়াদায়ক এবং ভীষণ উদ্বেগের। এ ধরনের বড় দুর্ঘটনাগুলো ঘটার পর কিছুদিন উত্তপ্ত পরিস্থিতি থাকে। কিছুদিন আলোচনা-সমালোচনা হয়, কিন্তু কিছুদিন পর আবার তা থেমে যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা এ বিষয়গুলোতে সচেতন হচ্ছি না, কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে না । দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষও কখনো যথাযথ নজরদারি করছে না বলে ঘুরেফিরে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আমরা মনে করি, যাদের গাফিলতিতে এমন অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে।’