![উচ্চ মূল্যস্ফীতি : অতিষ্ঠ মানুষ](uploads/2024/03/11/1710137680.INflaction.jpg)
একটা সময় ছিল, যখন মানুষ পকেটভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে যেত। আর ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে বাসায় ফিরত। এখন মানুষ ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে যায়, আর পকেটভর্তি বাজার নিয়ে ফেরে।
বাজার নিয়ে এটি একটি চালু প্রবাদ। এই প্রবাদ ফিরে ফিরে আসে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কালে। এবারও ফিরে এসেছে। সম্প্রতি বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। এ যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বিদ্যুতের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে।
বাজারে লাগামহীনভাবে বাড়ছে পণ্যের দাম। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সে অনুযায়ী বাড়ছে না মানুষের আয়। এ কারণে জীবনযাপনে দুর্ভোগ বাড়ছে। বিশেষত, গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দামের আগুনে ছটফট করছে তারা। কিছুতেই স্বস্তি মিলছে না।
মূল্যস্ফীতি হলো একধরনের করের মতো, যা ধনী-গরিব-নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ বাড়ায়। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া মানে গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে ভোগান্তি বেড়ে যাওয়া।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সরকার নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছে। নির্বাচনি ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নিত্য পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। তার পরও বাজারে স্বস্তি ফিরছে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেছেন, জনগণের কষ্ট লাঘবে তার সরকার সব সময় সচেষ্ট। সে জন্য মূল্যস্ফীতি কমাতে শুল্কছাড়সহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ অনুভূত হচ্ছে।
শুল্কছাড়ের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় ভূমিকা রয়েছে। তা হলো মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বাড়ানো। বাংলাদেশ ব্যাংক দেরিতে হলেও সেটা করেছে। কিন্তু তাতে খুব একটা সুফল মিলছে না। যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অনেকেই নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে কখনোই মূল্যস্ফীতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কারণ মূল্যস্ফীতির একটা বড় কারণ হচ্ছে সরবরাহজনিত ঘাটতি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেয়, সেটাই হচ্ছে নীতি সুদহার। মূল্যস্ফীতি বেশি থাকলে সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়ালে তফসিলি ব্যাংকগুলোর সুদহার বেড়ে যায়। তখন ঋণ ব্যয়বহুল হয়। ফলে ঋণের প্রবাহ কম থাকে এবং বাজারে টাকার সরবরাহ কমে যায়। আর বাজারে টাকার সরবরাহ কম থাকলে জিনিসপত্রের দাম বেশি বাড়তে পারে না। এটা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মুদ্রানীতির একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হাতিয়ার ব্যবহার করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর মধ্যে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। জানা যায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয় ৬ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে এটা লক্ষ্যমাত্রার অনেক ওপরে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। ভারতে মূল্যস্ফীতি এখন ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ১০ শতাংশ। অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে নেমে এসেছে। ২০২২ সালে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬৯ শতাংশ। এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে। অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি আকাশছোঁয়া, ৩০ শতাংশ। বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি নেমে আসে ৩ দশমিক ১ শতাংশে। যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি।
যোগাযোগ করা হলে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক ড. জায়েদ বখত খবরের কাগজকে বলেন, নীতি সুদহার বাড়ালে মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে আসবে, তা ঠিক নয়। এটা করা হয় ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমোনোর জন্য। তখন মুদ্রা সরবরাহ কম হয় এবং তার ফলে সামগ্রিক চাহিদা কমে। এর ফলে দ্রব্যের দাম কমার কথা।
তিনি মনে করেন, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি এমনিতেই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তার চেয়েও কম। সুতরাং সেদিক থেকে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতি কমানোর খুব একটা সুযোগ নেই। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সরকারের হাতে আর কী অস্ত্র রয়েছে? এর উত্তরে বলেন, আমদানি শুল্ক কমিয়ে জিনিসপত্রকে সহজলভ্য করতে হবে। পাশাপাশি টাকার বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখতে হবে।
দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম নীতি সুদহার বাড়ায় গত বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে। এর পর থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোর সুদহার বাড়াতে থাকে। বর্তমানে ঋণের সুদহার ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলেও মূল্যস্ফীতি কমছে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশ লম্বা সময় ধরে দেখা যাচ্ছে। এটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়। মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও সমন্বিত উদ্যোগের অভাব আছে।
ড. জায়েদ বখত বলেন, মূল্যস্ফীতির পেছনে বড় একটা কারণ হচ্ছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, যা এখনো অব্যাহত আছে। সহসা নিয়ন্ত্রণে আসার সম্ভাবনা কম। ডলারের মূল্য যদি বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়, তা হলে তো মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে। সে জন্য আমি মনে করি, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রয়োগে খুব বেশি সুফল পাওয়া যাবে না।
তা হলে নীতি সুদহার আরও বাড়ানো উচিত বলে আপনি মনে করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এটা করা ঠিক হবে না। কারণ এমনিতেই ঋণপ্রবাহ কম। ঋণপ্রবাহ কমিয়ে অর্থনীতিকে স্থবির করে দেওয়া যথাযথ পদক্ষেপ হবে না।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত ১৭ জানুয়ারি ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুনের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতির অন্যতম লক্ষ্যই ছিল মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নীতি সুদহারের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণের সুদহার বৃদ্ধির পরও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, সুদহার বৃদ্ধি হলে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ে দুই ভাবে। প্রথমত. মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধি রোধ করা। দ্বিতীয়ত. যেখানে আছে, সেখান থেকে নামিয়ে আনা। এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি রোধ হয়নি। এক মাসে কমলে, আবার পরের মাসে বাড়ছে। সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তার মানে ৪ শতাংশ বা ৪০০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা দেখলে বলা যায়, সুদহার ৬০০ বেসিস পয়েন্ট থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ক্রমান্বয়ে ১১০০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত বেড়েছে। এর ফলে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় বলা যায়, নীতি সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগটি আমরা দেরিতে শুরু করেছি। তা ছাড়া যথেষ্ট মাত্রায় করা হয়নি। যা করা হয়েছে, সেটাও খুব ধীরগতিতে হয়েছে। ফলে এর প্রভাব বেশি আশা করা যায় না।’
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, মূল্যস্ফীতি রোধ করা যায় যদি অন্য সবকিছু ঠিক থাকে। আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে জ্বালানি ও ডলারের সংকট। ডলারে ইদানীং কিছুটা স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এই বৃদ্ধি তো মূল্যস্ফীতিকে ধাক্কা দেবে। কাজেই সুদহার বৃদ্ধির প্রভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এটা বলার সময় আসেনি এখনো।
এ মুহূর্তে নীতি সুদহার আরও বাড়ানোর প্রয়োজন আছে কি- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সুদহার যদি একই জায়গায় থেকে যায়, তা হলে বুঝতে হবে বাজারে চাহিদা রয়েছে ভালোভাবেই। কারণ বেশি সুদ দিলেও ঋণ নিচ্ছে তার মানে, বুঝতে হবে চাহিদা আছে। ঋণপ্রবাহের ওপর প্রভাবটা দেখতে হবে। আমাদের তথ্য-উপাত্ত থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
বিভিন্ন দেশের উদাহরণ প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘যেসব দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে তাদের সঙ্গে যদি আমরা তুলনা করি তা হলে দেখা যাবে ওই সব দেশে তিন-চার মাসের মধ্যে ৮০০ বেসিস পয়েন্ট থেকে ৯০০ বেসিস পয়েন্ট সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে দ্রুত মূল্যস্ফীতি নিচে নেমে এসেছে।’
তিনি মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সরবরাহ একটি বড় সমস্যা। নীতি সুদহার দিয়ে শুধু চাহিদাকে আক্রমণ করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে আমাদের আমদানির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়েছে। ফলে উৎপাদন কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতিতে চাপ তৈরি হয়েছে।
আমার কথা হলো, আমরা কেন অভিজ্ঞতা থেকে শিখি না। রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে সরকারি উদ্যোগ কাজে লেগেছে। এটি এখন ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রেটে ছাড় দিলে জোগান যে বাড়ে এটা তো আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে খুবই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। কাজেই আমার পরামর্শ হলো বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বাফেদা-এবিবির মডেল থেকে সরে এসে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক।