পণ্য কিনতে বা সেবা নিতে গিয়ে প্রতিনিয়তই ঠকছে মানুষ। প্রতারিত হলে প্রতিকার পাওয়ার জন্য আইনও আছে। অথচ ভোক্তারা এই আইন সম্পর্কে এখনো তেমন কিছুই জানেন না। ফলে পদে পদে ভোগান্তি আর হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে সেসব মানুষকে। মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষিত ও সচেতন ব্যক্তি ছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের এই আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। এ কারণে ব্যবসায়ীদের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের তুলনায় অভিযোগের সংখ্যা খুবই কম।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইনে বেচাকেনার ফলে প্রতারণার ঘটনা বেড়েই চলেছে। ভোক্তা অধিকার আইন সম্পর্কে দেশের মানুষের বড় অংশের অজ্ঞতাই হয়ে উঠেছে ব্যবসায়ীদের প্রতারণার মূল হাতিয়ার। অর্থাৎ ভোক্তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও আইনটি পাস হয়েছে ১৪ বছর আগে। এরপর আরও কয়েক বছর সময় চলে গেছে ভোক্তাদের অধিকার রক্ষার কার্যক্রম শুরু করতে। এই কার্যক্রমে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিভিন্ন বাজার, শপিংমল ও সুপারশপে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের জরিমানা করতে শুরু করেন। এতে কিছুটা হলেও ভোক্তা অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকারিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচারণামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। আজ ১৫ মার্চ শুক্রবার বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসে সারা দেশে ব্যাপক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জন সচেতনতামূলক কর্মসূচিও পালন করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে। ভোক্তারা সচেতন না হলে সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা প্রতারণা করেই যাবেন। এ জন্য শুধু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ দিবস নয়, সব সময়েই প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে ভোক্তা অধিকার আইন কার্যকর করতে হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দেশে ভোক্তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনের প্রয়োগ থাকতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ১৮ কোটি ভোক্তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জনবল বাড়ানোর বিকল্প নেই।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক ঊর্ধ্বতন গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার রক্ষায় বিদ্যমান আইনটি সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’
১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কংগ্রেসে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে বক্তৃতা দেন। নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার- ভোক্তাদের এ চারটি মৌলিক অধিকার সম্পর্কে তিনি আলোকপাত করেন।
১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ ভোক্তা অধিকার রক্ষার নীতিমালায় কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরও আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করে। এরপর থেকেই কনজ্যুমার্স ইন্টারন্যাশনাল এ সকল অধিকারকে সনদে অন্তর্ভুক্ত করে। একই সঙ্গে কেনেডির ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৫ মার্চকে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ঘোষণা করে। সেই থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিনটি যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়। আইন অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত আদায়, বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন না থাকা, নোংরা পরিবেশে মানহীন ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও পরিবেশন, পণ্যে ভেজাল, ওজনে কম, বেশি দাম নেওয়া, ত্রুটিপূর্ণ পণ্য, ক্রেতার সঙ্গে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ ও অবৈধ মজুতদারিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ আইনে মোট ৮২টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৭ ধারায় পণ্যের মোড়ক না থাকলে বা মোড়কে পণ্যের তথ্য না থাকলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ৩৮ ধারায় পণ্যের দাম সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে বিক্রেতা ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৩৯ ধারায় সেবার দাম সংরক্ষণ এবং সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪০ ধারায় পণ্যের ধার্যকৃত মূল্যের বেশি বিক্রি, সেবা বা ওষুধ বেশি মূল্যে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৪১ ধারায় ভেজাল ওষুধ বা পণ্য বিক্রি করলে অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৪২ ধারায় খাদ্যপণ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশিয়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড, ৪৩ ধারায় জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন পণ্য অবৈধ উপায়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড, ৪৪ ধারায় পণ্যের মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করলে অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
যেভাবে অভিযোগ দায়ের
অভিযোগ অনলাইন ও সরাসরি দুইভাবেই করা যায়। অভিযোগের ফরম অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেই আছে। পণ্য বা সেবা কেনার পর ৩০ দিনের মধ্যে লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে হবে। ফ্যাক্স, ই-মেইল, ওয়েবসাইট ইত্যাদি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে অভিযোগ করলে এরসঙ্গে পণ্য বা সেবা গ্রহণের মূল্য পরিশোধের রসিদ যুক্ত করতে হবে। অভিযোগ যথাযথভাবে দায়ের করলে অধিদপ্তর শুনানির তারিখ নির্ধারণ করে উভয় পক্ষকে ডাকবে। এরপর একজন কর্মকর্তার সামনে শুনানি হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।
ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান
ভোক্তা স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনার সময়ে বিভিন্ন বাজার, আড়ত, মুদি দোকানসহ নিত্যপণ্য বিক্রয়কারী পাইকারি ও খুচরা প্রতিষ্ঠান কারখানা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, শিশুখাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে। এসব অভিযানে ইচ্ছে মতো বাড়তি মূল্যে পণ্য বিক্রির অভিযোগসহ মানহীন ভেজাল খাদ্যপণ্য, ক্ষতিকর উপাদান মিশ্রিত পণ্য তৈরি, ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণে পণ্য নজরকাড়া করতে হরেক রকম অসততা, অনিয়ম ও অনৈতিকতার দায়ে জরিমানা করা হয় অভিযুক্তদের।
আইন সংশোধন প্রক্রিয়াধীন
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন সংশোধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এতে শাস্তির ব্যাপ্তি আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেখানে কারাদণ্ড ও জরিমানা বাড়ানো ছাড়াও এ আইনে ই-কমার্স ব্যবসাকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।