প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন বেইজিং সফরকালে শীর্ষ বৈঠকে বেইজিংয়ের কাছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা, নতুন ঋণ ও ঋণের সুদহার কমানোর মতো প্রস্তাব দিতে পারে ঢাকা। অন্যদিকে বেইজিং চায় ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে ঢাকার সমর্থন। এ ছাড়া তিস্তা প্রকল্পে ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে হলেও থাকতে চায় চীন। বেইজিং এ অবস্থায় ঢাকার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানোর কথা বলছে।
আগামী ৮-১১ জুন বেইজিং সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সফরকে চীন ও ভারতের মধ্যে ভারাসাম্য রক্ষার সফরও বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর হবে উন্নয়নমূলক। এই সফরে ভারতের আপত্তি নেই।
চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারতকে যেমন খুশি রাখা জরুরি, তেমনি চীনকেও খুশি রাখা জরুরি। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। দেশটির কাছ থেকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ পায় বাংলাদেশ। কাজেই বাংলাদেশ চাইলে চীন ও ভারত উভয়কেই তিস্তা প্রকল্পে যুক্ত করতে পারে।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভূমিকা নিতে চীনকে অনুরোধ করবে ঢাকা
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রসঙ্গ উঠলে নয়াদিল্লি ঢাকাকে বেইজিংয়ের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তখন ঢাকার পক্ষ থেকে নয়াদিল্লিকে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরকালে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরাও মনে করেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে চীনের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অফিশিয়ালি চীন বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যস্থতা করছে এবং দেশটির মধ্যস্থতায় তিনটি বৈঠকও হয়েছে ঢাকা-নেপিদোর মধ্যে।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিষয়ক মন্ত্রী লি জিয়ান চাও সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভূমিকা রাখতে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট বেইজিং। কিন্তু রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এ ক্ষেত্রে চীন যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করছে, যাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনও শুরু করা যায়।’
এ প্রসঙ্গে বেইজিংয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘চীনের সঙ্গে মায়ানমারের সরকার এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক। কাজেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
২০ বিলিয়ন ডলারের নতুন ঋণ চাইবে ঢাকা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের নতুন ঋণ চাইবে ঢাকা। এটা দুই দেশের সম্পর্কে ‘গেম চেঞ্জারে’র ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করে বেইজিং।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এবং ৫ বিলিয়ন ডলার চীনা মুদ্রা ইউয়ানে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে, যেটা আমদানিসহ বাণিজ্যে ব্যবহৃত হবে। এ ছাড়া সফরকালে ৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তাও চাওয়া হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সফরকালে যৌথ বিবৃতির বিষয় চূড়ান্ত করা হয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরকালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ৭ প্রকল্পে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ চাইবে ঢাকা। এ ছাড়া গাবতলী থেকে সদরঘাট হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রোরেলে (মেট্রোরেল-২) ঋণ দিতে আগ্রহী চীন। এই প্রকল্পে ৬০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। এ ছাড়া বরিশাল পর্যন্ত রেললাইন বিস্তৃত করা হবে। এ জন্য দরকার ৪১ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণেরও প্রস্তাব দেবে ঢাকা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘চীনের সুবিধা হচ্ছে তাদের অনেক উদ্বৃত্ত টাকা আছে। ভারতও কিন্তু চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়। কিন্তু অন্যরা চীনের কাছ থেকে ঋণ নিলে তাদের গায়ে জ্বালা করে।’
সুদহার কমানোর প্রস্তাব
প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে ঋণের সুদহার কমানোর প্রস্তাব দিতে পারে ঢাকা। গতবার যখন প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে গিয়েছিলেন, তখনই বিষয়টি নিয়ে বেইজিংকে অনুরোধ করেছিল ঢাকা। সূত্র জানায়, এবারও একই অনুরোধ করা হতে পারে।
এই অনুরোধের বিষয়ে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘তখন চীন সরকারকে অনুরোধ করে বলা হয়েছিল যে আমরা গরিব দেশ। তখন বেইজিং একটা ক্যাপ দিয়েছিল যে কোনোভাবেই সেটি ২ শতাংশের বেশি হবে না। কিন্তু ঢাকা এটাকে ১ শতাংশ করতে বলেছিল। এবারও হয়তো এমন প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রও বলছে, ২০১৬ সালে যেসব ঋণচুক্তি হয়েছিল, এবার তার চেয়ে ভিন্ন মডেলে ঋণচুক্তি সই হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে হলেও তিস্তা প্রকল্পে থাকতে চায় বেইজিং
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, চীন আশা করেছিল ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর চীনকে তিস্তা প্রকল্পের কাজ দেওয়া হবে। কিন্তু হঠাৎ করেই ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা ঢাকা সফরকালে তিস্তা প্রকল্পে বিনিয়োগে নয়াদিল্লির আগ্রহের কথা জানান।
এ অবস্থায় বেইজিং ঢাকাকে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে যে দিল্লির সঙ্গে যৌথভাবে হলেও তারা তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চায়। যদিও ঢাকা এখন পর্যন্ত বেইজিংয়ের এই নতুন প্রস্তাব নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
চীন যে এমন প্রস্তাব ঢাকাকে দিয়েছে, সেটি প্রথম ইউরেশিয়ান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়। তারপর সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের প্রস্তাব দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। পাশাপাশি তিনি এটাও জানান যে বেইজিং ঢাকার সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছে এবং ঢাকার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো হবে।
ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে ঢাকার সমর্থন চাইতে পারে বেইজিং
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভূ-রাজনৈতিকভাবে চীন বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রেও চীনের এই ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থেই ভূ-রাজনৈতিকভাবে বেইজিংকে সমর্থন করতে হচ্ছে ঢাকাকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ছাড়া ভূ-রাজনৈতিক কিছু ইস্যুতে বেইজিংও ঢাকাকে পাশে চায়। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে সম্প্রতি চীন কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ফিলিপাইনের জলসীমায় যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি নিয়ে চীন চিন্তিত। এই ইস্যুতে তারা হয়তো বাংলাদেশকে তাদের পাশে চাইবে। এদিকে কোয়াডে যেকোনোভাবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে চাপ রয়েছে। এই ইস্যুতে বেইজিং বরাবরই তাদের বিরোধিতার কথা ঢাকাকে জানিয়েছে।
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন করিব খবরের কাগজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখনকার ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে চীনারা হয়তো চাইবে বাংলাদেশ তাদের অবস্থানকে সমর্থন করুক। যেমনটা আমরা সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় দেখেছি। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে যে দ্বিপক্ষীয় গভীর সম্পর্ক আছে, সেটাকে পুঁজি করেই আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক জটিলতাগুলোর সমাধান করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এভাবে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক ক্রমাগত আরও বলিষ্ঠ হবে এবং সফরটি সফল হবে বলে আমি আশাবাদী।’