![চাটগাঁর ঐতিহ্যবাহী মেজবান এখন ইফতারে](uploads/2024/03/20/1710951457.Mejban.jpg)
চট্টগ্রামে মেজবানের মাংস এখন ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। সচ্ছল ব্যক্তিরা ইফতারের আইটেমে রাখছেন মেজবানের মাংসও। ফলে চট্টগ্রামের বিশেষ বিশেষ দোকানে বিক্রি হচ্ছে এ মেজবানির মাংস। বিশেষ করে চট্টগ্রামের বাইরের অতিথিদের কাছে খুবই পছন্দ চট্টগ্রামের মেজবানি। মাংসের সঙ্গে চনার ডাল ও নলার ঝোল ভোজনরসিকদের ভীষণ পছন্দ। চাহিদা থাকায় দিন দিন বাড়ছে হোটেলে মেজবানি বিক্রি।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্য এই মেজবান। গরু জবাই করে সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। ধনী-গরিব এক কাতারে বসে খাওয়া হয়। পরিবেশন হয় মাংস, হাড় দিয়ে চনার ডাল, নলা ঝোল। মুখরোচক খাবারে সবাই তৃপ্ত হন। এখন আর সেই মেজবান সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন চলে এসেছে হোটেল-রেস্তোরাঁয়। আস্ত গরু জবাই করে মেজবানি রান্না করে মাংস বিক্রি করা হয়। মানভেদে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা পড়ে এক-একজনের। হোটেলে বসে খাওয়া যায় মেজবান। এ ছাড়া কেজি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় পাওয়া যায় মেজবানের মাংস। এখন ইফতারিতে বিক্রি হচ্ছে এ মেজবানি।
বিগত ২০০০ সালের দিকে চট্টগ্রামের প্রথম হোটেলে মেজবানের আয়োজন করে হোটেল জামান। নগরের কোর্ট বিল্ডিং শাখায় তারা মেজবানি বিক্রি করত মাত্র ১০০ টাকায় প্রতিজন। এতে থাকত একজনের পরিমাণ মাংস, চনার ডাল ও নলার ঝোল। বর্তমানে মুরাদপুরের হোটেল জামান শাখা ও বায়েজিদ শাখায় মেজবানি চালু আছে। বিক্রি করা হয় প্রতি কেজি ১ হাজার ২০০ টাকায়, প্রতিজনে পড়ে ৩৫০ টাকা।
অতি সম্প্রতি চট্টগ্রামের আরও বেশ কিছু রেস্তোরাঁয় চালু হয়েছে মেজবানি বিক্রি। এর মধ্যে মেজ্জান হাইলে আইয়্যুন, কুটুমবাড়ি, মেজবানবাড়ি, নগরের ২ নং ষোলশহরে ক্যাফে আলী, চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম মার্কেটে রোদেলা বিকেল, ক্যাফে আল মক্কা অন্যতম। চট্টগ্রামের পাঁচ তারকা হোটেল র্যাডিসন ব্লু ও ‘দ্যা পেনিনসুলা’তেও বিক্রি হচ্ছে মেজবানি। এ ছাড়া মহানগরের চকবাজার, কাজীর দেউড়ি, মুরাদপুর, জিইসি, বহদ্দারহাট, নিউ মার্কেট, আগ্রবাদ, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন এলাকার রেস্তোরাঁয় বিক্রি হচ্ছে মেজবানি।
হোটেল জামানের মালিক মোহাম্মদ কায়সার জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘হোটেল জামান চট্টগ্রামের ঐতিহ্য মেজবানকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছিল। মেজবান সবার পছন্দ। বিশেষ করে ঢাকা থেকে যারা চট্টগ্রামে বেড়াতে আসতেন, তারা মেজবান খুঁজতেন। তাই আমার বাবা মোহাম্মদ জামান চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিং হোটেল জামান শাখায় মেজবানের আয়োজন করতেন প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার। এ দুই দিন দূর-দূরান্ত থেকে এসে মেজবান খেতেন গ্রাহকরা। এ শাখা সম্প্রতি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে আমাদের অন্য শাখায় মেজবান চালু আছে।’
তিনি বলেন, মেজবান এখন সর্বত্রই বিক্রি হচ্ছে। তবে অনেক হোটেল বাজার থেকে মাংস সংগ্রহ করে মেজবান হিসেবে বিক্রি করছে। এতে মেজবানের মান কমে যাচ্ছে। মেজবান করতে হলে আস্ত গরু জবাই করতে হবে। সেটি রক্ষা করে হোটেল জামান।
জামাল খানের মেজ্জান হাইলে আইয়্যুনের মালিক মনজুরুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘দূর-দূরান্ত থেকে মেজবান খাওয়ার জন্য এখানে অনেক মানুষ আসেন। আমরা ১ হাজার ২০০ টাকায় মেজবানের মাংস বিক্রি করছি। আমাদের ৫টি শাখা রয়েছে চট্টগ্রামে। সব শাখাতেই উল্লেখযোগ্য হারে বিক্রি হচ্ছে মেজবানি। মেজবানিকে ইফতারের আইটেম হিসেবে চালু করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। যদিও ইফতার হিসেবে বেচা-বিক্রি তেমন বেশি না, তবুও কিছু বিশেষ গ্রাহক হয়েছেন। তারা কিনছেন এই মেজবানি।’
চট্টগ্রামের অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁ সবখানেই নানা স্বাদের ও রকমারি ইফতারিতে ভরপুর দোকানগুলো। মুরগি, গরু, খাসির মাংসে তৈরি বিভিন্ন ইফতারি পসরায় চোখ ক্রেতাদের। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে হালিম, মেজবানি মাংস ও বিরিয়ানি।
দুপুর থেকেই হোটেল-রেস্তোরাঁয় পসরা সাজানো হচ্ছে ইফতারির। নামিদামি প্রত্যেক রেস্তোরাঁয় ৩০ থেকে ৪০ আইটেমের ইফতারসামগ্রী বিক্রি করা হচ্ছে। মুখরোচক ইফতারি খাবার পদে পদে সাজিয়ে পরিপূর্ণ করা হয় শোকেস। বিকেল গড়াতেই শুরু হয় বেচাকেনা।
নগরের পাঁচ তারকা হোটেল র্যাডিসন ব্লুতে আয়োজন করা হয়েছে এশিয়ান ও অ্যারাবিয়ান ইফতারের। ইফতারের সঙ্গে বিভিন্ন অফারও রেখেছে গ্রাহকদের জন্য। ওই হোটেলের সহকারী পরিচালক ফুড অ্যান্ড বেভারেজ গাজী মহিউদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, মেজবানির মাংসসহ ৪০টি আইটেম দিয়ে ইফতারের পসরা সাজানো হয়েছে র্যাডিসন ব্লুতে। দেশীয় খাবার, এশিয়ান ও অ্যারাবিয়ান কিছু খাবারের মেন্যু রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের রেস্তোরাঁ ১৯টি ব্যাংকে ৭০ কার্ডে বাই ওয়ান গেট ওয়ান অফার চলছে। র্যাডিসন ব্লুতে লবির পাশে ইফতার বাজার সাজানো হয়েছে। সেখানে থরে থরে সাজানো হয়েছে ইফতারের সব আইটেম।
হোটেল জামান মুরাদপুর শাখার ম্যানেজার মোহাম্মদ নাছিরউদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রামের প্রাচীন রেস্তোরাঁ হোটেল জামান মুরাদপুরে মেজবানি মাংস, সব ধরনের হালিম, সব রকম বিরিয়ানি, চিকেন কাবাবসহ ৭৬টি আইটেম রয়েছে ইফতারির সম্ভারে। ১ হাজার ২০০ টাকায় মেজবানের মাংস বিক্রি করছি আমরা।’
‘দ্য পেনিনসুলা’ চট্টগ্রামের পক্ষ থেকেও করা হয়েছে ইফতারির আয়োজন। প্রায় ৩০টি আইটেম নিয়ে এবারের ইফতারি বিক্রির বন্দোবস্ত তাদের। পেনিনসুলায় সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে পসরা। গ্রাহকের চাহিদা মতো সেখান থেকে পরিবেশন করা হচ্ছে পার্সেল। এ হোটেলে বসেও ইফতার করার ব্যবস্থা রয়েছে।
নগরের স্টেডিয়াম পাড়ায় ‘রোদেলা বিকেল’ মেজবানের গরুর মাংস বিক্রি করছে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজিতে। মুরাদপুরের হোটেল জামান থেকে প্রায় ৫০০ টাকার বিভিন্ন ইফতারি ও ১ হাজার ২০০ টাকায় মেজবানি মাংস কিনেছেন ব্যাংকার মোহাম্মদ নেজামউদ্দিন। তিনি বললেন, ‘দাম একটু বেশি হয়েছে। তবু গুণেমানে ভালো বলে এ হোটেল থেকে কিনেছি।’
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদুল হান্নান বাবু খবরের কাগজকে বলেন, ইফতারসামগ্রী বেশি দামে বিক্রির সুয়োগ নেই। সব নিত্যপণ্যের দাম এবার বেশি। রেস্তোরাঁয় ব্যবহার হওয়া সব ধরনের পণ্যের দাম অনেক হওয়ার ফলে সীমিত লাভে বিক্রি করতে হচ্ছে।