![কিশোরী মায়ের সংখ্যা বেড়েছে](uploads/2024/03/29/1711695614.Kishori_Mother.jpg)
নীলফামারীর জলঢাকার মেয়ে সুমাইয়া বেগমের বয়স সবে ১৫-তে পড়েছে। রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডের এক বেডে শুয়ে ছিল দেড় মাস বয়সী অসুস্থ পুত্রসন্তান আবিরকে নিয়ে। জন্মের পর থেকেই নানা রকম জটিলতায় ভুগছে শিশু আবির। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শিশুটির পুষ্টিহীনতা রয়েছে। সেই সঙ্গে মারাত্মক শ্বাসকষ্টে ভুগছে সে।
অক্সিজেন মাস্ক পরানো ছোট শিশুকে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে শুয়ে থাকা মা সুমাইয়ার মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। নিজের শরীরও খুব বেশি ভালো নেই এই কিশোরীর। শরীরে অপুষ্টির ছাপ স্পষ্ট। তবে চেহারায় ক্লান্তির ছাপ ছাড়িয়েও বেশি ধরা পড়ছে চোখের হতবিহ্বল দৃষ্টি। যে নিজেই শিশু, তার কাঁধে আরেকটি শিশুর বিশাল দায়িত্ব এসে পড়েছে। অথচ বুঝতেই পারছে না কী করবে সে।
এই অবস্থা শুধু সুমাইয়ার নয়, বরং দেশের আরও অনেক কিশোরীর। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’ শীর্ষক সর্বশেষ গবেষণার ফলাফলে দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের সারা জীবনে সন্তান জন্মদানের হারের পরিসংখ্যান উঠে আসে। গবেষণার তথ্যানুযায়ী দেশে ২০২৩ সালে ১৫ বছর বয়সী কিশোরী মেয়ের সন্তান জন্মের হার ১৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অথচ ২০২২ সালে এই হার ছিল ১১ দশমিক ৭৮ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে ১৫ বছর বয়সী মেয়েদের সন্তান জন্মের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।
একইভাবে ২০২৩ সালে ১৬ বছর বয়সী কিশোরী মেয়েদের সন্তান জন্মের হার ছিল ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ১৬ বছর বয়সী মেয়েদের সন্তান জন্মের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ১৭ বছর বয়সী কিশোরী মেয়েদের ২০২৩ সালে সন্তান জন্মের হার ছিল ৩৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের ২০২৩ সালে সন্তান জন্মের হার ছিল ৪৫ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ৪৩ দশমিক ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২ দশমিক ২৩ শতাংশ। ১৯ বছর বয়সী নারীদের ২০২৩ সালে সন্তান জন্মের হার ছিল ৫৭ দশমিক ৩২ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ৫৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০২৩ সালে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের গর্ভধারণের অনুপাত ছিল ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ২৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে গর্ভধারণের হার কমেছে শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ।
কিশোরী মেয়েদের সন্তান জন্মদানের হার বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোমা দে খবরের কাগজকে বলেন, দেশে করোনার প্রভাবে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক করুণ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। যার প্রভাব এখনো অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এ সময় অনেক মেয়ে পড়াশোনা থেকে ড্রপ আউট হয়ে যায়। পড়াশোনায় ভাটা, অর্থনৈতিক দুর্বলতা সবকিছু মিলিয়ে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো মেয়েদের কিশোরী বয়স পেরোনোর আগে বিয়ে দিয়ে দেয়। আর অল্প বয়সে জন্মদানে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সম্পর্কে অনেক মানুষই সচেতন না। তাই বিয়ের পর পরই সন্তান জন্মদানের চাপ থাকে ওই কিশোরীর ওপর। যার পরিণতিতে কিশোরী বয়সে মা হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিবিএসের গবেষণার ফলাফলে আরও উঠে আসে ২০২৩ সালে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে জীবিত সন্তান জন্মদানের হার ছিল ৮৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ৮৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জীবিত সন্তান জন্মদানের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০২৩ সালে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে মৃত সন্তান জন্মদানের হার ছিল ১ দশমিক ১০ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মৃত সন্তান জন্মদানের হার কমেছে শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ। ২০২৩ সালে একই বয়সী কিশোরীদের মধ্যে অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাতের হার ছিল ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাতের হার কমেছে শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ। ২০২৩ সালে একই বয়সী কিশোরীদের মধ্যে ইচ্ছাকৃত গর্ভপাতের হার ছিল ২ দশমিক ৩১ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাতের হার কমেছে শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ।
কিশোরী বয়সে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে ‘ওজিএসবি’র সভাপতি অধ্যাপক ড. সামিনা চৌধুরী বাল্যবিবাহের সমর্থনকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহের ফলে একজন কিশোরীকে কঠিন একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। খবরের কাগজকে তিনি জানান, এই বয়সটা একজন কিশোরী মেয়ের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে বিকাশের সময়। এই বয়সে বিয়ে দিলে মেয়েটি একটি গণ্ডিতে বন্দি হয়ে যায়। এ সময় সে নিজেই একজন বাচ্চা। এ বয়সে বাচ্চা জন্ম দিলে মা ও বাচ্চা উভয়েই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। বাচ্চার শারীরিক বৃদ্ধিতে জটিলতা, দুর্বল স্বাস্থ্য, মানসিক বিকাশ ব্যাহত হওয়া, কম ওজনের বাচ্চা জন্ম দেওয়া, অকালপ্রসব এবং প্রি-এক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকিসহ নানাবিধ প্রতিকূলতা থাকে, তা ছাড়া কিশোরী মায়ের বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ধকল সামলে বাচ্চার যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রেও অসুবিধা দেখা দেয়। এ সময় কিশোরী মায়ের শরীরের মধ্যেও হরমনের তারতম্য ঘটে। তা ছাড়া অল্প বয়সে বিয়ে করায় জরায়ুমুখে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কাও বেশি থাকে।