উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের দ্বন্দ্বে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি)। সেই দ্বন্দ্বের উত্তাপ লাগছে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে। গত কয়েক দিন ধরে উপাচার্যের পক্ষে-বিপক্ষে সভা-সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে উপাচার্যের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন শিক্ষকরাও। এসব কারণে ববির প্রশাসনিক ও একাডেমিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
এদিকে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য জানান, তাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তবে ববির শিক্ষক ও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ববি প্রতিষ্ঠাকালে সহ-উপাচার্যের পদটি শূন্য ছিল। প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পর গত ৩০ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ববির উপ-উপাচার্যের হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গোলাম রাব্বানিকে নিয়োগ দেন। এর আগে ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনকে। বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী প্রশাসনিক নির্বাহী কর্মকর্তা হলেন উপাচার্য। আর একাডেমিক দায়িত্ব পালন করবেন উপ-উপাচার্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা বলেন, উপ-উপাচার্যের যোগদানের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা প্রশাসনিক জটিলতা ও বিভাজন শুরু হয়। উপ-উপাচার্য যোগদানের দিন উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন না। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর তিনি ডেপুটি রেজিস্ট্রারের কাছে যোগদানপত্র জমা দেন। তবে যোগদানের পর থেকে উপ-উপাচার্যকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি আবাসন ও যানবাহন। তাকে অফিস কক্ষ দেওয়া হলেও তার কাছে কোনো ফাইল পাঠানো হতো না। উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে গত ৯ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন একাডেমিক অগ্রগতি জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের চেয়ারম্যানদের উপস্থিত থাকার আহ্বান জানান উপ-উপাচার্য।
কিন্তু উপাচার্যের নির্দেশের সব বিভাগের চেয়ারম্যানদের পাল্টা চিঠি দেন রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম। চিঠিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক নির্বাহী কর্মকর্তা উপাচার্য। তার নির্দেশ ও অনুমোদন ছাড়া দপ্তরপ্রধান, কর্মকর্তা বা অন্য কেউ শিক্ষক/কর্মকর্তা/কর্মচারীর উদ্দেশে কোনো পত্র পাঠাতে পারেন না। সংগত কারণে উপ-উপাচার্যের পত্রটি নিয়মবহির্ভূত। চিঠিটি কোনো শিক্ষককে আমলে না নেওয়ার জন্য উপাচার্যের নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
শিক্ষক ও কর্মকর্তারা আরও জানান, গত ৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ৪৯তম একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় সিন্ডিকেটের দুই শিক্ষক প্রতিনিধিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এ নিয়ে বেশির ভাগ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উপাচার্যের ওপর ক্ষুব্ধ হন। এ ছাড়া গত ১৩ ফেব্রুয়ারি উপাচার্য শুচিতা শরমিনের বিরুদ্ধে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের অভিযোগ তার পদত্যাগ দাবি করেন শিক্ষার্থীরা। এ দাবিতে তারা উপাচার্যের বাসভবন ও কার্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। এর আগে গত নভেম্বরে ড. শুচিতা শারমিন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ও রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে ববি একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য ও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের চাকরিকাল গণনা সংক্রান্ত কমিটি, একাডেমিক কমিটি এবং পরীক্ষা কমিটির সদস্য করেন।
এরপর শিক্ষার্থীদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে গত ১৯ নভেম্বর অধ্যাপক কলিমুল্লাহকে সব কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর গত ২৬ নভেম্বর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু হেনা মোস্তফা কামাল খানকে ট্রেজারার হিসেবে নিয়োগ দেন উপাচার্য। এই নিয়োগ নিয়ে শিক্ষকরা আন্দোলনের ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে আবু হেনা মোস্তফার নিয়োগ বাতিল করা হয়। আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন ড. কলিমুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সহচর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওইসব শিক্ষক ও কর্মকর্তারা জানান, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চক্র আছে, যারা সব আমলেই উপাচার্যর কাছাকাছি থেকে সুবিধা নিয়েছিল। সেই চক্রটিই উপাচার্যকে নানা বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গন্ডগোল পাকাচ্ছেন। চক্রটি রাজনৈতিক সুবিধাবাদী হিসেবে পরিচিত। তারা সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ্ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পরবর্তীতে তারা সাবেক মেয়র আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাতে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
৫ আগস্ট প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সুযোগে তারাই আবার ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগবিরোধী সেজে উপাচার্যের কাছে মানুষ হয়ে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছেন। উপাচার্য তাদের সেই কূটকৌশলে পড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল ইসলাম বলেন, ‘উপাচার্য ফ্যাসিস্টদের সহযোগীদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে পুনর্বাসন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। তিনি ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের জন্য গোপনে সিন্ডিকেটের সভাও ডেকেছেন। আমরা উপাচার্যের পদত্যাগ চাই।’
রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর শুচিতা শরমিন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে একের পর এক স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নিয়মবহির্ভূতভাবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সহযোগী রেজিস্ট্রারকে বহাল রেখে উপাচার্য একটি বলয় সৃষ্টি করছেন। জুলাই বিপ্লবের চেতনার পক্ষের শিক্ষকদের নানাভাবে হেনস্তা করছেন। দুজন শিক্ষক প্রতিনিধিকে সিন্ডিকেট থেকে বাদ দিয়েছেন। গোপন সিন্ডিকেট সভার আহ্বান ফ্যাসিস্টের সহযোগী দুজন শিক্ষককে সিন্ডিকেট সদস্য করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।
সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক মোস্তাকিম মিয়া বলেন, সাবেক কোষাধ্যক্ষ আবু হেনা মোস্তফা কামালের নিয়োগ বাতিলের দাবিতে আমি আন্দোলন করেছিলাম। এ জন্য উপাচার্য সিন্ডিকেট থেকে আমাকে বাদ দিয়েছেন।
একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য ও কোস্টাল স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, উপাচার্য দুজন শিক্ষক প্রতিনিধিকে মেয়াদপূর্ণ হওয়ার আগে সিন্ডিকেট থেকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। বাদ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শূন্য পদ পূরণ করা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে স্বৈরাচারের দোসররা দায়িত্বে আছেন।
এ বিষয়ে ববির উপাচার্য খবরের কাগজকে বলেন, ‘উপ-উপাচার্যের সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্ব আছে বলে আমি মনে করি না। যেভাবে গণমাধ্যমে নিউজগুলো আসছে তা অনিয়ম ও অনুচিত হচ্ছে। সবার বিশ্ববিদ্যালয় আইন জানা দরকার। আর সঠিক জায়গায় সঠিক কাজ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গতি হারাবে।’
তিনি বলেন, ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে ফ্যাসিস্টদের দিয়ে। সব রিক্রুমেন্টও ফ্যাস্টিদের। তাই সবাইকে বাদ দিতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হবে। যা সম্ভব নয়। তবে ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন কোনো ভাবে করা হবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমি যোগদানের পর থেকে দেখছি বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে একটি চক্র পাঁয়তারা চালাচ্ছে। তবে আমি কোনো ভাবেই কাউকে বরিশাল বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ে অস্তিত্বশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দেব না। শিক্ষা গ্রহণের জন্য সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশ গড়ে মানসম্মত আন্তর্জাতিক মানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা আমার দায়িত্ব। সে জন্য সব ধরনের কাজ আমি করে যাব। নতুন বাংলাদেশে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি বৈষম্যহীন বিশ্ববিদ্যালয়। সেই লক্ষ্যে আমি কাজ করছি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে সহ-উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বলেন, আমার সঙ্গে উপাচার্যের কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব নেই। আর শিক্ষার্থীরা যে সব ইস্যুতে আন্দোলন করছেন, সেগুলো তাদের বিষয়। আমি যোগদানের পর সাড়ে ৩ মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী কোনো দায়িত্ব পাইনি। দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য উপাচার্যকে মৌখিক ও লিখিতভাবে একাধিকবার অনুরোধ করেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উপাচার্য আমাকে অ্যাকাডেমিক দায়িত্ব বুঝিয়ে দেননি।
তিনি আরও বলেন, ‘এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম দেখভাল ও দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে একাডেমিক কার্যক্রমের অগ্রগতি ও সার্বিক অবস্থা জানার জন্য আমি বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভার আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু কি কারণে তিনি পালটা একটি চিঠি দিয়েছেন আমার জানা নেই। তার পরেও তার প্রতি সম্মান রেখেই সেই সভা বাতিল করেছি।