ঢাকা ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪

কবিতা আমার কাছে একটা অবিনশ্বর মায়াবী আশ্রম

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:১২ পিএম
আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:১২ পিএম
কবিতা আমার কাছে একটা অবিনশ্বর মায়াবী আশ্রম
কবি আসাদ মান্নান

কবিতার বরপুত্র আসাদ মান্নান জানেন শব্দের ষোলোকলা- শব্দের দক্ষ ক্রীড়নক তিনি। ছত্রিশ ব্যঞ্জনায় তার কবিতার শব্দেরা বাজে অহর্নিশ। পাঠককে করে তোলে মোহাবিষ্ট। সময়ের নদী বেয়ে তার শব্দতরী নোঙর ফেলে সময়াতীতের মহাসমুদ্রে। তার শব্দেরা আছড়ে পড়ে দূর কোনো সৈকতের দুরন্ত জল-কোলাহলে। পাঠক কুড়িয়ে নেয় তার অনুভবের নুড়ি-পাথর। তার হৃৎপিণ্ড যেন পাখি হয়ে প্রাণহীন নগর পাড়ি দিয়ে বসত গড়ে কল্লোলিত স্নিগ্ধ হাওরে।…

সত্তর দশকের অন্যতম শক্তিশালী কবি আসাদ মান্নানের জন্ম ৩ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। কাব্যবুননে, ধরনে ও কৌশলগত রীতিতে তার স্বকীয় প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে আসছেন। বাংলা কবিতায় নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেছেন তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। বলতে গেলে তা ঈর্ষণীয়। কবি আসাদ মান্নান একজন সুপরিচিত এবং সুনন্দিত এক নাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ (অনার্স) ও এমএ সম্পন্ন করেছেন। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসহ, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার, তথ্য মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক, সরকারের সচিব হিসেবে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন-এর একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সূর্যাস্তের উল্টোদিকে’ (১৯৮১)। গ্রন্থ সংখ্যা ১৫টি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ (২০২১)-সহ নানান পুরস্কার ও সম্মাননা।

আপনি এখন কী পড়ছেন? 
প্রতিদিন আমি কিছু না কিছু পড়ে থাকি; বিশেষ করে এ প্রজন্মের কবিদের কবিতা এবং তাদের কবিতা বিষয়ক গদ্য ও আলোচনা-সমালোচনা। পড়ার টেবিলে এরকম বহু বই পড়ে আছে বহুদিন ধরে। যখন যা মন চায় হাত বাড়িয়ে ওখান থেকে দু-একটা তুলে আনি বিছানায়- শুয়ে শুয়ে পড়ি, পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি, ঘুম ভাঙলে জেগে উঠি, আবার পড়ি। এতদিন গল্প-উপন্যাস পড়ার জন্য ফুরসত পাইনি। বেশ কিছু উপন্যাস, গল্পের বই অনেক দিন ধরে বইয়ের তাকে এতিম শিশুর মতো পড়ে আছে- ওদের দিকে এতদিন মনোনিবেশ করা যায়নি পেশাগত ব্যস্ততায়। এখন আর সেই ব্যস্ততা নেই- বই-ই আমার নিত্যসঙ্গী। নন্দিত কথাশিল্পী ও নাট্যকার ফেরদৌস হাসানের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘ডাক দিয়ে যায়’, কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল-এর সম্প্রতি প্রকাশিত ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘কারবালা উপাখ্যান’, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ‘বঙ্গবন্ধু কী চেয়েছিলেন?’, পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত কথাশিল্পী, কবি ও ‘কৌরব’ সম্পাদক কমল চক্রবর্তীর লেখাগুলো পড়ছি। পড়ছি তরুণ কথাশিল্পী ও গবেষক স্বকৃত নোমানের ‘বাংলায় ইসলাম সহজিয়া ও রক্ষণশীল ধারা’ নামের একটি অসামান্য গবেষণামূলক গ্রন্থ। টেড হিউজ ও সিলভিয়া প্লাথ সম্পর্কে লিয়াকত আলী খানের বাংলা ও ইংরেজিতে লিখিত দুটি বইও এ তালিকায় রয়েছে। এর বাইরে ছোটো কাগজে চোখ বুলচ্ছি। বলতে পারেন রসান্ন সময় পার করছি অবসর যাপনের মধ্য দিয়ে।

কবিতা পড়ব কবিতা লিখব, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ পড়ব না, তা তো হয় না! অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাংলা কবিতার এক অনিবার্য অবিনাশী শক্তি ও সৌন্দর্য, এখানে তিনি একক ও অনন্য। তাকে ধারণ করার সামর্থ্য সবাই রাখে না। আমার সাধ্য ও সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে অবুঝ শিশুর মতো আমার অস্তিত্বে ও অহংকারে জড়িয়ে রেখেছি অনুক্ষণ। আর জীবনানন্দ! হ্যাঁ, কবুল না করে উপায় দেখছি না- জীবনানন্দের কবিতা না পড়লে আমার মনে হয় কবিতার সঙ্গে আমার এভাবে সংসার হতো না। 

আপনি এখন কী লিখছেন? 
কবিতা লিখছি টুকটাক। আমাদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে একটা অস্থির সময় গেছে, সে সময় বেশ কিছু রাজনৈতিক কবিতা লিখেছি মনের তাগিদে। এখন চেষ্টা করছি আমার স্বকীয় অনুভবে ফিরে আসতে। প্রায় প্রতিদিন দু-একটা কবিতা লিখতে চেষ্টা করছি; তবে কবিতার জন্য যে ঘোর ও উন্মাদনা দরকার সেটির তীব্রতা মনে হয় কমে আসছে।

নিজে কবিতা লিখছি বলে কবিতার প্রতি আমার টান ও ঋণ একটু তো বেশি-ই হবে। আমার ব্যক্তি জীবনে যা কিছু অর্জন বলা যায় তার সবটুকু কাকতালীয়ভাবে কবিতার জন্য সম্ভব হয়েছে। কবিতা না লিখলে আমার এ জীবনটা হয়তো-বা অন্যরকম হতো। আমার সামান্য কিছু গদ্য আছে; তবে তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। মনে হচ্ছে বড় ভুল করে গেছি- গদ্যের মহলে যে এক অপরিসীম আলোর ভুবন রয়েছে সেখানে প্রবেশ না-করে। জীবনের এমন কিছু বিষয় রয়েছে যাকে গদ্যে লিখতে হয়- এটা জেনেও শুধুমাত্র নিজস্ব ভাষার দেখা না পেয়ে ওখানে হাত দিতে পারিনি। এ আক্ষেপ আমার থেকে যাবে বোধ হয়!

কবিতা আমাকে কেন এত কাছে টানে? খুবই জটিল প্রশ্ন। একটা সরল বাক্যে যদি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম! প্রেমিক বা প্রেমিকা পরস্পরকে যেভাবে কাছে টানে কবিতাও আমাকে টানে। কবিতাকে ভালোবেসে সবিতাকে দূরে ঠেলে রাখি, আকাশ জড়িয়ে তার ডানার পালকে উড়ে গেছে কত পাখি ও পাপিয়া; তবুও কবিতা অন্তরঙ্গ অসুখের মতো আমাকে আক্রান্ত করে। এ ক্ষেত্রে শব্দই আমার একমাত্র অস্ত্র, যা দিয়ে আমি কবিতার অন্দর মহলে প্রবেশ করে নিরাময় খোঁজি; খুঁজে পাই কবিতাকে- কবিতা আমার কাছে একটা অবিনশ্বর মায়াবী আশ্রম।
খবরের কাগজ সাহিত্যপাতা ‘সুবর্ণরেখা’ এগিয়ে যাক আপন ভুবনে- এই কামনাই রইল। 
ধন্যবাদ আপনাকে।

সাক্ষাৎকার: সানজিদ সকাল

ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:৩৮ পিএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:৪০ পিএম
ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

গত সংখ্যার পর

কী ব্যাপার এত রাতে জেগে আছ যে- খাবার খেলে না? শরীর খারাপ কি? 
স্ত্রীর কথায় দত্ত বাবু বললেন, না ঠিক আছি, আচ্ছা শোন, তুমি তো সাবিনা নামের প্যাসেন্টটাকে দেখেছ? কী মনে হয় তোমার? 
গাইনোকলজিষ্ট স্ত্রী বললেন- বারকয়েক দেখেছি। ভেবেছিও। ও রকম একটা ছোট্ট মেয়ের ওপর যে টরচার হয়েছে তাতে ওর বেঁচে থাকাই কঠিন। কিন্তু সে বেঁচে আছে! 

কিন্তু জানিনে কীভাবে তা সম্ভব? তোমার কী মনে হয়? ওকে কি নরমাল লাইফ দেওয়া সম্ভব হবে? 
ভেরি ডিফিকাল্ট। শুনলাম, জ্ঞান ফিরলে আবারও ফেইন্ট হচ্ছে। রক্তপাত বন্ধ করা যাচ্ছে না। জেনিটাল অরগানগুলো টোটালি ড্যামেজ্ড। আগে জেনারেল হেল্থটাকে ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করা যাক, পরে না হয় সার্জারির কথা ভাবতে পার। কিন্তু আগরতলায় সে রকম প্লাস্টিক সার্জন পাবে কোথায়? 

সবই জানি, কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জটা নিতে চাই স্বপ্না। কী নিঃষ্পাপ ফুলের মতন ফুটফুটে মেয়ে, ঠিক আমাদের মেয়ের মতন!
স্বামীর মুখ দেখে ওর মনটাকে বোঝবার চেষ্টা করে স্ত্রী। বলে- দেখ চেষ্টা করে- আমিও থাকব তোমাদের সঙ্গে। 

গভীর রাতে ডাক্তার দত্ত ও তার স্ত্রী যখন কথা বলছিলেন ঠিক তখনই বর্ডারের ওপার থেকে রাইফেল-মেশিনগানের কর্কশ আওয়াজ শোনা গেল। একই মাটি, একই আলো-বাতাস, ভাগ হয়েছে দুই দেশের সীমানায়। আগরতলায় বসে পূর্ববঙ্গের গাছে বসা পাখির গান শোনা যায়, মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, মাঠে কৃষকের গান, ট্রেন চলার শব্দ- সব কানে আসে। অতএব, আগ্নেয়াস্ত্রের লাগাতার শব্দ রাতের শহর আগরতলাকে কাঁপিয়ে তুলল। এরই মধ্যে পাশের ঘর থেকে আতঙ্কিত মেয়ে দেবলীনা দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। কামান দাগার বিকট আওয়াজ হতেই দেবলীনা মাকে ছেড়ে বাবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ডাক্তার দত্ত বললেন- ওপারে যুদ্ধ চলছে মা, আমাদের ভয়ের কিছু নেই। 

কিন্তু আমার ভয় করে বাবা। ভীষণ ভয় করে। কিছুই ভালো লাগে না। 
শরণার্থী সংকট ও যুদ্ধের কারণে দেবলীনাদের স্কুল বন্ধ। সারা দিন শুয়ে-বসে থাকতে হয়। আগের মতো বন্ধুরা কেউ আসে না, সেও যেতে পারে না কোথাও। এভাবে সময় কাটাতে তার একদম ভালো লাগে না। 

সে রাতেই আগরতলা এয়ারপোর্টের কাছে কামানের গোলা পড়ল কয়েকটা। বিকট শব্দে কুঞ্জবনে রথীন দত্তের বাড়িটাই কেবল কেঁপে উঠল না গোবিন্দ বল্লভ হাসপাতালও কেঁপে উঠল। ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে ভয়ানক আতঙ্ক ছড়াল। সবাই ছোটাছুটি শুরু করল। সাবিনার মা পারভীন আক্তার নিজেও সৈন্যদের দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সপ্তাহ কয়েক চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলেও এখনো ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। কাছাকাছি কোথাও কামানের গোলা পড়ায় তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন। অনেক কষ্টে পা ফেলে মেয়ের বেডের দিকে এগিয়ে গেলেন। ভয়ে, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সাবিনা। মা কাছে যেতেই তাকে জড়িয়ে ধরে বলল- ওই যে মিলিটারি আসছে মা, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। 

মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলেন পারভীন আক্তার। আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন। বললেন- ভয় পাস না মা- এটা ইন্ডিয়া, আরেক দেশ, জল্লাদেরা এদিকে আসবে না। 

কিন্তু সাবিনার আর্তচিৎকার থামানো গেল না। সে কাঁপতে থাকল। নাক থেকে অক্সিজেনের নলটা টেনে খুলে ফেলল। কোমরের নিচের নলগুলো খোলার চেষ্টা করল। পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে পারভীন আক্তার চিৎকার করে নার্স ডাকলেন। সঙ্গে সঙ্গেই দুজন নার্স দৌড়ে এল। এসেই একজন শক্তি দিয়ে সাবিনাকে চেপে ধরল, অন্যজন নাকমুখের নলগুলো লাগিয়ে দিতে দিতে বলল- এ রকম করলে কী চলে! লক্ষ্মী মেয়ে, প্লিজ, তুমি চুপ করে থাক। এখানে কোনো ভয় নেই তোমার। আমরা আছি তো। 

৫. 
৫ আগস্ট ১৯৬৫ সাল। নতুন উত্তেজনা শুরু হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান আকস্মিকভাবে তার ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ শুরু করলেন। হাজার হাজার পাকিস্তানি সেনা রাতারাতি ঢুকে পড়ল জম্মু ও কাশ্মীরে। ভারতের হাত থেকে কাশ্মীর মুক্ত করতে হবে। শান্তিপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী বিপাকে পড়লেন। হুকুম দিলেন ভারতের সেনাবাহিনীকে পাল্টা আক্রমণের। ৫ আগস্ট থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর- চলল সাত সপ্তাহের ভয়ংকর যুদ্ধ। মারা গেল দুই দেশের হাজারো সেনা। ধ্বংস হলো ঘরবাড়ি, স্থাপনা। 

সে যুদ্ধে ভারত পূর্ব ফ্রন্টে যুদ্ধ চালায়নি। যদি আক্রমণ হতো তাহলে কী ছিল পূর্ব অংশের প্রতিরক্ষা দেওয়ার? কিছুই নেই! আত্মরক্ষার যা কিছু সবই পশ্চিম পাকিস্তানে! অতএব, শক্ত অবস্থান নিলেন শেখ মুজিবুর রহমান: কেবল অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু নয়, সামরিক দিক দিয়েও অরক্ষিত রাখা হয়েছে বাংলাকে। এর থেকে পরিত্রাণ দরকার।

৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সাল। পূর্ব বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে শেখ মুজিবুর রহমান তার ছয় দফা দাবি পেশ করলেন। প্রথমত লাহোরে- পরে ঢাকায় ফিরে বিস্তারিতভাবে। পূর্ব বাংলাসহ প্রদেশগুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। প্যারামিলিটারি রাখার অধিকার দিতে হবে। বিদেশ বাণিজ্যের অধিকার থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পূর্ব পাকিস্তানের জন্যই ব্যয় হবে। অতএব, মোড় ঘুরে গেল পাকিস্তানি রাজনীতির। ছয় দফার স্লোগানে কাঁপতে থাকল পূর্ব পাকিস্তান, জেগে উঠতে থাকল বাঙালি। বিপরীতে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল সামরিক জান্তার। দিন যত যেতে লাগল, ধর্মের বর্ম-পরা গণবিরোধী শাসকচক্রের চোখে পাকিস্তানি অখণ্ডতার পয়লা নম্বরের দুশমন হয়ে উঠলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। শুরু হলো লাগাতার নিপীড়ন, জেলজুলুম। প্রথমত, হেনস্থার কূটকৌশল আঁটা হলো; দ্বিতীয়ত, চলল স্বাধিকারের আন্দোলনকে স্তব্ধ করার সর্বগ্রাসী ষড়যন্ত্র। 

শেখ মুজিবুর রহমান এবং কিছু বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা কি সত্যি সত্যি ভারতের সাহায্য নিয়ে হাজার মাইল দূরের উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি দাসত্ব হঠাতে চেয়েছিলেন? চাইলেও চাইতে পারেন, আপত্তির কিছু ছিল না। কিন্তু এ নিয়ে কোনো বিবৃতি দেননি শেখ মুজিব, গ্রহণযোগ্য কোনো গবেষণাও হয়নি। তবে আগরতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের একবারের আগমন নিয়ে রাজ্যের সেদিনকার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের একটি স্মৃতিচারণ আছে। 

চলবে...

১ম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব

৪র্থ পর্ব

৫ম পর্ব

৬ষ্ঠ পর্ব

৭ম পর্ব

৮ম পর্ব

কারবালা উপাখ্যান: ইতিহাসের রক্তক্ষরণ কিংবা শিল্প ও সত্যের যাপন

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:৩৩ পিএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:৩৩ পিএম
কারবালা উপাখ্যান: ইতিহাসের রক্তক্ষরণ কিংবা শিল্প ও সত্যের যাপন

খেলাফতের উত্তরাধিকার নিয়ে মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন ও ইয়াজিদের মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনা মানব ইতিহাসের অন্যতম একটি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসেবে বিধৃত ও স্বীকৃত। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া ওই প্রতারণামূরক যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাত এখনো বিদ্যমান। মুসলিম বিশ্ব এখনো দ্বিধাবিভক্ত। এখনো ওই ঘটনা স্মরণ করে মুসলিম সম্প্রদায় ব্যথিত ও কাতর হন। 

প্রায় দেড় হাজার বছর আগের সেই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল লিখলেন নতুন উপন্যাস কারবালা উপাখ্যান।

কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে হাজার হাজার গ্রন্থ লেখা হয়েছে। ফিকশন, নন-ফিকশন, ইতিহাস, গজল, মর্শিয়া, আখ্যান আরও নানা ধরনের রচনা। ইতিহাসের অংশ হিসেবে এই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে নানাভাবে। মুসলিম বিশ্ব এবং অমুসলিম বিশ্ব বিভিন্ন প্রক্ষেপণে আলো ফেলে বোঝার চেষ্টা করেছে এই যুদ্ধের কারণ, গতিপ্রকৃতি এবং অভিঘাত। তবে সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো এই ঘটনা নিয়ে খোদ মুসলিম বিশ্বে এখনো দ্বিধা-বিভক্তি চলমান। রয়েছে অতিরঞ্জন। এসবের ভিড়ে মূল ইতিহাস এবং এর আসল প্রবাহ বের করা খুবই কঠিন।

কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে শত বছর আগে বাংলাভাষায় বিষাদ সিন্ধু নামে উপন্যাস লিখেছিলেন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন। মুসলিম লেখকদের মধ্যে লেখা এ উপন্যাসটিকেই প্রথম সার্থক উপন্যাস হিসেবে গণ্য করা হয়। বিপুল পঠিত ও সমাদৃত হয় এ উপন্যাস। এমনকি বাঙালি মুসলমান এই গ্রন্থটিকে ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবেও মর্যাদা দিয়ে এসেছে এর প্রকাশের পর থেকে আজ অব্দি। মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেক বাড়িতেই দেখা গেছে ধর্মীয় গন্থের সঙ্গে বিষাদ সিন্ধুর একত্র সমাবেশ।

প্রশ্ন হলো, একুশ শতকে এসে এরকম একটি উপন্যাস লেখার উপযোগিতা কী? যে ঘটনা বহুশ্রুত, জ্ঞাত, উল্লিখিত, বর্ণিত, চর্চিত। সে-ঘটনা নিয়ে কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল কেন নতুন করে আরেকটি উপন্যাস লিখতে বসলেন। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে কারবালা উপাখ্যানের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। শুধু এর কাহিনি নিয়ে নয়, এর কাঠামো, ভাষা, উপস্থাপন নিয়ে কথা বলতে হবে। 

প্রথমে আমরা এর কাহিনির দিকে তাকাই। আমার সঙ্গে হয়তো-বা অনেকেই দ্বিমত করবেন না এই বিষয়ে যে, বর্তমান সময়ে আমরা এক ধরনের তথ্যের নৈরাজ্যের মধ্যে বসবাস করছি। একসময় আমাদের তথ্যের অপ্রতুলতা ছিল ব্যাপক। এরপর তথ্যের অপ্রতুলতা ঘুচলেও স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের কারণে তথ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপতথ্য। যুক্ত হয়েছে অর্ধসত্য। ফলে এখন চলেছে তথ্যের নৈরাজ্য। এখন কোনো তথ্য পাওয়ার পর সেটা ফ্যাক্টচেক না করে গ্রহণ করলে গোলমাল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। 

কারবালার ঘটনাও এর ব্যতিক্রম নয়। কোন তথ্য ঠিক, কোনটা বেঠিক, কোনটা অর্ধসত্য, কোনটা অপতথ্য তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যেতে হয়। কারণ একেক উৎসে একেক ধরনের তথ্য। এমনকি পরস্পর বৈপরীত্যও লক্ষ্যণীয় সেসব তথ্যে। কারবালার ঘটনা নিয়ে এরকম ঘটার কারণ হলো বিভিন্ন মতাদর্শ। বিভিন্ন ধরনের মত বা থিওরি প্রয়োগ করার জন্য যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় তার অনুসারী বাড়ানোর জন্য ইচ্ছেমতো ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তা করা হয় নিজেদের হীন স্বার্থে। এর মধ্য থেকে নির্ভেজাল ইতিহাস বের করে আনা সাধারণের পক্ষে কঠিন।

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল কঠোর পরিশ্রম করে নির্ভেজাল ইতিহাসের আলোকে লিখেছেন এ উপন্যাস। ফলে বলতেই পারি- সাধারণের পক্ষ্যে যা কঠিন লেখক তা সহজ করে দিয়েছেন। অপতথ্য আর অর্ধসত্যের ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন এই সময়ে সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে লেখা এ উপন্যাসকে তাই সময়ের সঠিক দিশারি বলা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, কারবালা উপাখ্যানের কাঠামো, বর্ণনা ও ধারাবাহিকতা। এ ক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভালো যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের একটি বড় গুণ হলো আবেগ বিবর্জিত হওয়া। কিন্তু কারবালার ঘটনা এতই মর্মান্তিক যে, একজন মুসলমান হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে এই ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত ও আবেগাপ্লুত হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কারবালার ঘটনা মূল ঘটনা থেকে বিচ্যুত হওয়ার এটাও একটা কারণ। লেখকও তো মানুষ। কাজেই কারবালার ঘটনায় আবেগাপ্লুত হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল এখানে খুব সংবরণের পরিচয় দিয়েছেন; যা কারবালা নিয়ে লিখতে গিয়ে অধিকাংশ লেখকই ব্যর্থ হন। তারা ইতিহাসের অংশে আবেগ নিয়ে প্রবেশ করায় মূল জিনিস থেকে বিচ্যুত হয়ে যান। মোস্তফা কামালের লেখকসত্তা এখানে ব্যক্তিসত্তাকে ছাপিয়ে গভীরতা ও সত্যসন্ধানী পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে উঠেছে। তাতে কী হয়েছে? তাতে ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে, অযাচিত আবেগের হাত থেকে উপন্যাসটি রক্ষা পেয়েছে। আর পেরেছে ইতিহাসগ্রন্থ না হয়ে উঠতে। হয়ে উঠেছে উপন্যাস।

ইতিহাস বিকৃতি থেকে মুক্ত হওয়া, তথ্যের বিকৃতি না করা, ইতিহাসের পরম্পরা থেকে হঠাৎ বিচ্যুত না করা, অহেতুক ভাবালুতায় আক্রান্ত না হওয়া এবং আবেগবর্জিত হওয়ার দরুণ কারবালা উপন্যাসের ভাষা হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক তরতরে। আরও সহজ করে বললে বলতে হবে- একুশ শতকীয়। অর্থাৎ একুশ শতকীয় ভাষায় প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের অন্তরে-বাহিরে ভ্রমণ করার সুযোগ।

শুধু তাই নয়, ওই সময়ের, ওই দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর যে রূপ তা এই সময়ে এই দেশের কাঠামোর অনুরূপ নয়। লেখক ঘটনার অভিঘাত ও পরম্পরা বোঝানোর জন্য ওই কাঠামোগুলো তাদের আদিরূপে দেখাননি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নিরাপত্তার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। আমরা যাদের আমাদের দেশের এই একুশ শতকীয় ভাষায় পুলিশ, গোয়েন্দা ইত্যাদি নামে অভিহিত করে থাকি। কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল ওই সময়ের শৃঙ্খলা-কাঠামো বোঝাতে গিয়ে ওই সময়ের পদ-পদবি উল্লেখ করেননি। করেছেন এই সময়ের আলোকে। ফলে পাঠকের পক্ষে ঘটনার গভীরে প্রবেশ করে চরিত্রের গতিবিধি লক্ষ্য করে কার কী ক্ষমতা ও ভূমিকা তা সহজেই অনুধাবন করতে পারে। একটি উপন্যাসের সঙ্গে মনো-সংযোগের এই উপাদান মোস্তাফা কামাল খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন।

আবেগের অতিশয্য নেই, ভাষার কচকচানি নেই, ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেওয়ার জন্য কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশ নেই, কাউকে মহান বানানোর গোপন অভিসন্ধি নেই, কাউকে ছোট করার নির্লজ্জ অভিপ্রায় নেই। এরকম নির্মোহ হয়ে লিখেছেন মোস্তফা কামাল।

ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার কিছু ঝুঁকি থাকে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে যখন চরিত্রগুলো বাস্তব হয়। ঐতিহাসিক উপন্যাসের মূল উপাদান যদি শুধুই সময় হয়ে থাকে, এবং শুধু সময়কে ধারণ করার অভিপ্রায় থেকে লেখক লিখতে চান তাহলে তার ঝুঁকি কম। সাধারণ চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে সময়ের অভিপ্রায় ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তার রেখে যাওয়া ছাপ ও অভিঘাত তুলে ধরার জন্য তিনি ইচ্ছেমতো কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশ ঘটাতে পারেন। কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাসের মূল উপাদান যদি ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে থাকে তাহলে ঝুঁকি অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে সময় অবধারিতভাবেই নির্দিষ্ট। আগের অবস্থায় চরিত্র ছিল অনির্দিষ্ট। এ ক্ষেত্রে চরিত্রগুলো নির্দিষ্ট, ঐতিহাসিক, সুপরিচিত, সুবিদিত এবং বহুল চর্চিত। এরকম চরিত্র নিয়ে, জানা ঘটনা নিয়ে, বহুল চর্চিত বিষয় নিয়ে ফিকশন লেখা সহজ কথা নয়। বলা বাহুল্য, এ ধরনের রচনার সবগুলো উপাদানই হলো নন-ফিকশনাল কিন্তু লেখক লিখতে বসেছেন ফিকশন। চরিত্রের প্রকৃত রূপ ঠিক রেখে এ ধরনের বিষয় নিয়ে ফিকশন লেখা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এই দুঃসহ-ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে অনেক মেধার প্রয়োজন হয়।
 
লেখক মোস্তফা কামাল এই ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুঃসহ কাজটি নিজ দায়িত্বে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এই গুরুদায়িত্ব তাঁকে দিয়ে যে মহান কাজটি করাল তাতে কয়েকটি কাজ সাধিত হলো। যেমন, বাংলা সাহিত্য একটি উপন্যাস পেল। যে উপন্যাসে তথ্যের কোনো নৈরাজ্য নেই, আবেগের বাহুল্যতা নেই, কাউকে বড়ো করে দেখানোার কপট মাহাত্ম্য নেই, কাউকে ছোট করে দেখানোর নির্লজ্জ কপটতা নেই, ইতিহাসের মোড় ঘুড়িয়ে দেওয়ার গোপন অভিসন্ধি নেই, সর্বোপরি ইতিহাসের উপাদান নিয়ে কপট ধর্ম প্রচার নেই। তিনি আসলে ফিকশন রচনা করতে চেয়েছেন। আর তাতে ইতিহাসের সত্য, যাপনের সত্য, চরিত্রের সত্য ও ক্ষমতার চরিত্র নিয়ে দেখাতে চেয়েছেন ইসলামের এক নাজুক সময়কে। 

পাঠক যদি নির্ভেজাল তথ্যের আলোকে ওই সময়টাকে যাপন করতে চান, মর্মোদ্ধার করতে চান ওই সময়ের চরিত্রের, তাহলে এ উপন্যাসের সঙ্গে যাপন করতে পারেন। সে-যাপন শিল্প ও সত্যের আলোকে আলোকিত হয়ে উঠবে।

কারবালা উপাখ্যান
লেখক: মোস্তফা কামাল
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪
সময় প্রকাশন
প্রচ্ছদ: মেধা রোশনান সারওয়ার
মূল্য: ৪৬০ টাকা

এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

রাত সাড়ে ১০টার মতো হবে। গ্রামের বৃক্ষশোভিত পথ। সংকীর্ণ পাকা রাস্তা। রাস্তার দুধারে লাইটপোস্ট নেই বলে ঘন অন্ধকার। আকাশে চাঁদ থাকলে এতটা অন্ধকার হতো না। গ্রামে অটোরিকশা, মোটরবাইকের চলাচল ৯টার পরেই বন্ধ হয়ে যায়। যানবাহনহীন নির্জন পথটা কালো সাপের মতো শুয়ে আছে চুপচাপ। 

সেই রাস্তার নিস্তব্ধতা এবং অন্ধকার ছিঁড়ে মোটরবাইক চালিয়ে যাচ্ছিছিলেন থানার ওসি আরমান খন্দকার। সবাই তাকে ওসি আরমান বলে। সহযাত্রী হিসেবে তার মোটরবাইকের পেছনে বসেছিলেন তার সহকর্মী এসআই খবির। তারা বিরামপুর বাজারের দিকে আসছিলেন। অবশ্য থানায় যাওয়ার জন্য বাজারের আগেই ডান দিক দিয়ে একটা পথ বেরিয়ে গেছে। হয়তো তারা চা খেতে আসছিলেন। বিরামপুর বাজারে রাত সাড়ে ১০টা/১১টা পর্যন্ত চা পাওয়া যায়। আর এখানে রশীদ মিয়ার চায়ের সুনামও আছে। সেই সঙ্গে সবাই জানে ওসি আরমানের বেপোরোয়া চায়ের নেশার কথা। 

ওসি আরমান আর এসআই খবির গিয়েছিলেন শালপাতা গ্রামে সিদ্দিক ব্যাপারীর মেয়ের বিয়ের দাওয়াতে। রাত ৯টার ভেতর তাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে। ওসি আরমান গল্পবাজ মানুষ। খাওয়ার পর গল্পসল্পে কেটে গেছে ঘণ্টাখানেক।

বাজারের ঠিক আগে আসতেই আচানক গাছের আড়াল থেকে কে যেন টালমাটাল পায়ে রাস্তায় বের হয়ে এল। সে গান গাইছে-
এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে 
আমার পৃথিবী থেকে
আলোর পথে আর কেউ নেবে না
আমারে কখনো ডেকে।

ওসি আরমান আপ্রাণ চেষ্টায় দুর্ঘটনা এড়ালেন। আর একটু হলে মোটরবাইক নিয়ে পাশের খাদে চলে গিয়েছিলেন। বাইশ বছর ধরে মোটরবাইক চালাচ্ছেন। দক্ষ চালক বলেই সামলে নিতে পারলেন। 

এসআই খবির ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। লাঠি হাতে তেড়ে গেলেন টালমাটাল পায়ের যুবকের দিকে। ওসি আরমান তাকে নিরস্ত করলেন। বোঝা যাচ্ছে যুবকটা মাতাল। বর্তমানে তাড়িমদ খুব সহজ হয়ে গেছে। অন্যসব রকম মাদক ঠেকানো গেলেও তাড়িমদ ঠেকানো যাচ্ছে না। কারণ এগুলো বাড়িতেই তৈরি করা যায়। আর এ ধরনের মদ একটু বেশি খেলেই মদখোর বেশামাল হয়ে পড়ে। 

যুবকটা বলল- ওসি সাহেব, আমার নাম মনোয়ার হাসান। সবাই হাসান নামে চেনে। এই যে বাজারের লাগোয়া আমাদের বাড়ি। ম্যাথমেটিকস-এ মাস্টার্স শেষ করেছি এবার। 

সবাই তাকে হাসান নামে চিনলেও ওসি আরমান বা এসআই খবির তাকে চিনতে পারলেন না। তাদের চেনার কথাও না। ওসি আরমান বললেন- আপনি এভাবে অন্ধকারে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছেন যে? আর একটু হলেই তো আমি দুর্ঘটনায় পড়তাম। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি। 
ওসি আরমানের এ কথায় কান না দিয়ে হাসান বলল- মিলুর বিয়ের দাওয়াত থেকে এলেন ওসি সাহেব?

সিদ্দিক ব্যাপারীর মেয়ের নাম মিলু ওসি আরমান তা জানে। ওসি আরমান কিছু বলার আগেই এসআই কবির বললেন- আপনি তো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। জানেন, আপনাকে আমরা এখন থানায় নিয়ে যেতে পারি?

-নিয়ে যান। আমাকে বেঁধে থানায় নিয়ে যান। কঠিন একটা মামলা দিয়ে আমাকে জেলে আটকে রাখেন। খুনের আসামি করে ফাঁসি দিতে পারলে আরও ভালো হয়। মানুষের জগৎ আমার আর ভালো লাগে না। মানুষের এই জগতে আছে শুধু স্বার্থপরতা, অবিশ্বাস। এখানে প্রেমের নামে চলে সাপলুডু খেলা। আমাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পারবেন?

মাতাল হলে লোকে নানারকম ভাবের কথা বলে। চাকরিসূত্রে ওসি আরমান আর এসআই খবিরের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে। হাসান ম্যাথমেটিকস-এ মাস্টার্স। 

সে কেন তাড়িমদ খেয়ে এরকম মাতলামি করছে? এ গ্রামে এরকম শিক্ষিত তো খুব বেশি নেই। ওসি আরমান বললেন- হাসান সাহেব বাজারে আসেন। চা খেতে খেতে আপনার সঙ্গে কথা বলব। 
-কী বিষয়ে কথা বলবেন?
-কথা বলার বিষয় পাওয়া যাবে। 
-মিলুদের সঙ্গে কি আপনার কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে?
-না, তা নেই। 
-তাহলে বিয়েতে দাওয়াত দিল যে? থানার ওসি, এসআইদের তো দাওয়াত দেয় যারা এলাকার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারা। মিলুর বাপ সিদ্দিক ব্যাপারী তো সেরকম কেউ নন। 
-আমাকে দাওয়াত দেওয়ার কারণটা ভিন্ন।
-কী কারণ? 
-আমি তিনবার এই মেয়েটার বিয়ে ভেঙে দিয়েছি। চতুর্থবারের মাথায় তার বিয়ে সম্পন্ন হলো। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। বড় চাকরি করে। তো তারা আমার কাছে কৃতজ্ঞ। আগে যেসব ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তারা এরকম যোগ্য ছিল না। তাদের স্ট্যাটাস অনেক নিচে ছিল। 
-চলেন বাজারে যাই। বাজারে গিয়ে চা খেতে খেতে কথা বলি।

ওসি আরমান বাইক টান দিয়ে রশিদ মিয়ার চায়ের দোকানে গেল। শত হলেও থানার ওসি। গ্রামের মানুষের কাছে ভয়ের এবং সম্মানের ব্যক্তি। উপস্থিত লোকজন দ্রুত সরে গিয়ে পুরো একটা বেঞ্চি খালি করে দিল। রশিদ মিয়া বলল- স্যার, কী চা খাইবেন, দুধ চা না লাল চা? দুধ চায়ে খাঁটি 
গরুর দুধ দিই। লাল চা যদি খান তো লেবু, আদা, পুদিনা পাতা আছে।
ওসি আরমান বললেন- একটু পরে, হাসান আসুক।
এ কথা শুনে উপস্থিত লোকদের চোখে-মুখে বিস্ময় জাগল। হাসানকে তারা সবাই চেনে। হাসানের সঙ্গে যে ওসি সাহেবের খাতির আছে তা কেউ জানত না। 

মিনিট সাতেকের মধ্যে হাসান এল। তার টালমাটাল অবস্থা কমেনি। হাসান এত রাতে তাড়িমদ খেয়ে হাঁটছে এ ব্যাপারটাও উপস্থিত লোকদের বিস্ময়ের কারণ হলো। শিক্ষিত-ভদ্র যুবক হিসেবেই তাকে সবাই চেনে। এলাকার অনেকের ছেলেমেয়েকে সে গণিত প্রাইভেট পড়ায়। সে তাড়িমদ খাবে একথা কেউ কল্পনাও করেনি। ওসি আরমান সরে গিয়ে হাসানকে বসতে দিলেন। হাসান বসলে ওসি আরমান বললেন- আমাদের তিনজনকে লাল চা দিন। 

লাল চায়ে চুমুক দিয়ে হাসান বলল- ওসি সাহেব, মূলত আপনি মিলুর বিয়ে ভাঙেননি। তিনবারই মিলুর বিয়ে ভেঙেছি আমি। সবাই ঝট করে তাকাল হাসানের মুখে। ভাবল, তাড়ির মাদকতায়ই হয়তো সে এমন কথা বলছে। তবে কণ্ঠ জড়ানো নয়, স্পষ্ট ও স্বাভাবিক। 
হাসান আবার বলল- ওসি সাহেব, তিনবারই কিন্তু ফোন গিয়েছিল যে, এই ঠিকানায় একটি বাল্যবিবাহ হতে যাচ্ছে। মেয়েটা লেখাপড়ায় ভালো। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে। বিয়ে হলে মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। জাতি বঞ্চিত হবে একটি শিক্ষিত মা থেকে। 
ওসি আরমান বললেন- হু, তিনবারই ফোন পেয়ে আমি ফোর্স নিয়ে ছুটে এসেছিলাম। বিয়ে ভেঙে দিয়েছি।

-ফোনগুলো কে করেছিল?
-দিন-তারিখ দিয়ে সব রেকর্ড করা আছে। দরকার হলে বের করতে পারব। দরকার বোধ করিনি।
-ফোনগুলো করেছিলাম আমি। তবে এবার আর পারলাম না। এবার সে প্রাপ্তবয়স্ক। অনার্স ফোর্থ সেমিস্টারে পড়ে। নিজের জীবন নিজেরই বোঝার সক্ষমতা রয়েছে। আমার ফোনে কোনো লাভ হতো না। থানা-পুলিশ আমার ফোনকে বিশেষ গুরুত্ব দিত না। 

ওসি আরমান বিষয়টা বুঝতে পারলেন। উপস্থিত অন্যরাও বুঝতে পারল। একটা ভালোবাসার নির্মম সমাপ্তি ঘটেছে। কেউ কিছু বলছিল না। কী আর বলবে? বলার মধ্যে হাসানকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু বলা যায়। এসব ক্ষেত্রে সান্ত্বনা খুব একটা কাজে আসে না। প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে। যুবকটা তাড়িমদ খেয়ে অন্ধকার রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কতটা কষ্ট তার বুকে বাজছে তা কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না।

হাসান লম্বা একটা চা শেষ করে কাপটা নিঃশেষ করে কাপটা পাশে নামিয়ে রেখে বলল- অথচ মিলু বলেছিল, এতদিন তুমি আমার বিয়ে ভেঙেছ। এখন আর তোমাকে এই ঝুঁকিতে যেতে হবে না। বাবা যদি আবার আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে তো আমিই ভেঙে দিতে পারব। নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স আমার হয়েছে। তুমি ভারমুক্ত থাক, এবার একটা চাকরি জোগার কর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কী করল আমার জন্য? কথা কি রাখল?

কেউ কিছু বলল না। প্রেম-বিরহের গল্পগুলো সাধারণত একই রকম হয়। যার কষ্ট সে-ই শুধু বোঝে। একটু থেমে হাসান আবার বলল- মাত্র চার দিন আগেও মিলু আমার পাশাপাশি বসেছিল। আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অনেক কথা বলল। ঘুণাক্ষরেও আমি বুঝতে পারলাম না যে, মাত্র চার দিন পরই মিলু আরেকজনের বাসর আলোকিত করতে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য বলেন ওসি সাহেব!

ওসি আরমান পকেট থেকে একটা কয়েন বের করলেন। কয়েনটা দুই আঙুলের ফাঁকে ধরে বললেন- এই যে কয়েন। কয়েনের দুটা দিক আছে। একটা হেড আরেকটা টেল। এর বেশি কিছু নেই। প্রেমেরও তাই। প্রেমে হয় বিরহ, নয় মিলন। জ্ঞানীরা বলেন, প্রেম বিরহেই অধিক উজ্জ্বল। বিরহেই প্রেমের সৌন্দর্য চির অমলিন। মিস্টার হাসান, মিলু আপনার হৃদয়ে চির অমলিন হয়ে থাকবে। শত চেষ্টা করলেও আপনি তাকে হৃদয় থেকে মুছতে পারবেন না। সে চলে গেছে অন্যের অধিকারে, তাই বলে আপনি কিন্তু তাকে ঘৃণাও করতে পারবেন না। সে আপনার চিরন্তন ভালোবাসা। ঠিক মিলুর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই। ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে যত সুখ আর প্রাচুর্যের মধ্যেই সে থাক, তার মনের মণিকোঠায় আপনার জন্য একটু জায়গা শূন্য থাকবেই। কেউ সে শূন্যতা ভরাট করতে পারবে না।

হাসান মাথা নিচু করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর ওসি আরমান বললেন- হাসান সাহেব, আমি তাহলে...। 
হাসান মাথা তুলল। সবাই দেখল হাসান কাঁদছে। পুরুষ মানুষের নিঃশব্দ কান্নার ভেতর কতটা কষ্ট লুকিয়ে থাকে তা পুরুষমাত্রই উপলব্ধি করতে পারে। ওসি আরমান হাসানের কাঁধে, পিঠে হাত রাখলেন, আলত আঘাত করলেন, তারপর উঠে গেলেন। 

চায়ের দোকানের লোকজন চলে গেল। দোকানদার মজনু মিয়া বলল- হাসান ভাই, বসেন। দোকান বন্ধ করে আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাব। 

দোকান বন্ধ করতে করতে মজনু মিয়া বলতে লাগল- ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছও আবার নতুন করে বাঁচার জন্য মাথা তুলে দাঁড়ায়। নতুন ডাল হয়। নতুন পাতা গজায়। ফুল ফোটায়। ফল ফলায়। এরকম কষ্ট অনেকের জীবনেই আছে। এই যে সারা দিন আমার সামনে চায়ের কেটলিতে পানি ফোটে, একটা কষ্ট আমার ভেতরও ফুটতে থাকে অবিরত। কেউ বোঝে না। বুঝে কী করবে বলেন? এই কষ্টের আগুনে এতটুকু পানি দেওয়ার সাধ্য তো কারও নেই। আমি চা বানায়া মানুষকে খাওয়াই। হেসে হেসে কথা বলি। আনন্দ করি। কিন্তু ভেতরে হৃদয়টা প্রায়ই হাহাকার করে ওঠে। চলেন হাসান ভাই, চলেন যাই।

হাসান উঠে দাঁড়াল। কাঁপা কাঁপা ভরাট কণ্ঠে গেয়ে উঠল- 
এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে 
আমার পৃথিবী থেকে...

জীবনের স্বাদ

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:২০ পিএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:২০ পিএম
জীবনের স্বাদ

ক্ষুদ্র পরিসরের জীবনে-
নিদারুণ সময় স্রোতের বেড়াজালে থমকে গেছি।
উপেক্ষিত হয় ভালোবাসার আবেদন,
পরিযায়ী পাখির মতো-
নীল জলে প্রাসাদ গড়ে নীরবতা,
উপেক্ষার সরলসূত্র ধরে জীর্ণ জীবনতরী
গোপন আগুনে জ্বলেছি জমে যাওয়া অভিমানে,
উপসংহারের পথে হাঁটতে থাকি একাকী,
নিঃস্ব জীবনে ভাসতে ভাসতে জেনেছি-
প্রিয়জনের স্পর্শ ছাড়া
পাওয়া যায় না জীবনের স্বাদ।

পুতুলজন্ম

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:১৮ পিএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:১৮ পিএম
পুতুলজন্ম

‘সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায়’
হেমন্ত ছুঁয়ে তোমায় ছুঁয়েছি বারবার 

সে কিশোরীবেলা, বালিকা-বালিকা দিন 
হলুদ-ছোপানো রঙে বেণীপুতুল সাধ 

প্রহর শেষের আলো তোমার দু’চোখে 
অঙ্গারে রাঙা নির্মিত চলাচল 

কাদামাটি ছেনে গড়েছ আমায় 
অস্তরাগের সে রোদে 
                                শুধু  
                                       পুড়ে গেলাম...!