![গল্পজাদুকর উপেন্দ্রকিশোর](uploads/2024/05/10/a1-1715331008.jpg)
এ কেমন আজব ছেলেরে বাবা! ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের সব শিক্ষক ভীষণ অবাক। ছেলেটিকে সবাই খুব পছন্দ করেন। ছেলেটা প্রতিদিন ক্লাসে পড়া পারে। পরীক্ষায় কখনো সেকেন্ড হয় না। সবসময় প্রথম। দুরন্ত মেধা আর বিপুল প্রতিভা। কিন্তু এ কেমন আজব ছেলে! স্কুলের পাঠ্যবিষয়ে তার একেবারেই আগ্রহ নেই। পড়াশোনাও করে না ঠিকমতো। রাতে তো এক অক্ষরও পড়ে না। তবু প্রথম হয়। কেমন করে?
শিক্ষকরা ধরে বসলেন ছেলেটিকে। ‘ঘটনা কী উপেন্দ্র? রাতে একটুও পড়াশোনা কর না। তবু প্রথম হও কী করে? ক্লাসে পড়াই বা দাও কেমন করে?’
ছেলেটি জবাব দিল, ‘শরৎকাকা আমার পাশের ঘরেই থাকে। রোজ সন্ধ্যায় সে চিৎকার করে করে পড়া মুখস্ত করে। ওতেই আমার পড়া হয়ে যায় যে!’
নাহ। এরপর কি আর কিছু বলা যায়?
এভাবেই চলতে থাকল বছরের পর বছর। চলতে চলতে একসময় চলে এল সেই কঠিন সময়। প্রবেশিকা পরীক্ষা।
নাকের ডগায় পরীক্ষা। ক্লাসের সবাই পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত। দম ফেলবারও ফুরসৎ নেই কারও। পড়তে পড়তে সবাই যেখানে হাঁপিয়ে যাচ্ছে, সেখানে উপেন্দ্র কি না বেহালা আর রংতুলি নিয়ে মজে আছে! স্কুলের প্রধান শিক্ষক রতনমণি গুপ্ত ডেকে পাঠালেন ছেলেটিকে। বললেন, ‘তোমার ওপর আমাদের অনেক আশা। তুমি আমাদের হতাশ কোরো না।’
ভীষণ অনুতপ্ত হলেন উপেন্দ্র। বাড়ি ফিরে সাধের বেহালাটি ভেঙে ফেললেন নিজে।
কেবল বাজনাই নয়, ভালো ছবিও আঁকতে পারতেন উপেন্দ্রকিশোর।
একবার ময়মনসিংহ জেলা স্কুল পরিদর্শনের জন্য এলেন স্যার অ্যাশলি ইডেন। এই অ্যাশলি ইডেন ছিলেন তৎকালীন ভারতের গভর্নর। তার নামেই ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ। যাই হোক, ছাত্ররা ক্লাসে মন দিয়ে ইডেন সাহেবের কথা শুনছে, নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। হঠাৎ ইডেন দেখলেন পেছনের বেঞ্চিতে বসা একটি ছেলে তার কোনো কথাই শুনছে না। মাথা নিচু করে কিছু একটা করছে। ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষকদেরও নজরে পড়েছে এটা। শঙ্কিত হয়ে উঠলেন শিক্ষকরা। না জানি সাহেব কী মনে করেন।
ওদিকে চুপি চুপি ছেলেটির কাছে এলেন ইডেন। এসে দেখলেন ছেলেটি একমনে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা প্রতিকৃতি আঁকছে। আর সেটা স্বয়ং অ্যাশলি ইডেনের প্রতিকৃতি।
নিজের প্রতিকৃতি দেখে ভীষণ খুশি হলেন ইডেন সাহেব। জানতে চাইলেন, ‘কী নাম তোমার?’
চমকে উঠে জবাব দিল ছেলেটি, ‘উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী’।
এবার উপেন্দ্রর পিঠ চাপড়ে দিয়ে অ্যাশলি বললেন, ‘কখনো আঁকা ছেড়ো না। এটাই চালিয়ে যেও।’ এমনই ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। কে এই উপেন্দ্রকিশোর?
তিনি সুকুমার রায়ের বাবা। এবং সত্যজিৎ রায়ের দাদা। আর?
অনেক বছর আগের কথা।
বিহার থেকে এক কায়স্থ পরিবার এল নদীয়ার চাকদহ গ্রামে। কয়েক পুরুষ বাদে ওই পরিবার পাকাপাকিভাবে চলে এল ব্রহ্মপুত্রের ধারে ‘খুকুরপাড়া।’ পরে গ্রামের নাম বদলে হয় ‘মসুয়া’। ততদিনে মুঘল রাজসরকারে কাজ করার সুবাদে পাওয়া ‘রায়’ উপাধিকেই পদবি করে নিয়েছেন তারা। গড়ে তুলেছেন জমিদারি। মসুয়ার সেই অভিজাত পরিবারের মানুষদের অনেক গুণ। বহুভাষাবিদ হিসেবে তাদের বেশ সুনাম। তেমনি এক বহুভাষাবিদ পণ্ডিত কালীনাথ রায়। কালীনাথের পাঁচ ছেলে। সারদারঞ্জন, কামদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন, প্রমদারঞ্জন।
পাঁচ বছর বয়সে পণ্ডিত কালীনাথের দ্বিতীয় পুত্র কামদারঞ্জনকে ১৮৬৮ সালে দত্তক নেন নামি উকিল ও জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী। যাগযজ্ঞ করে কামদারঞ্জনের নাম বদলে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। নিজের সন্তান না থাকায় জ্ঞাতী ভাই কালীনাথের মেজো ছেলেকে দত্তক হিসেবে নেন হরিকিশোর। যদিও এর কয়েক বছর পরে হরিকিশোরের নিজের একটি ছেলে হয়। তার নাম নরেন্দ্রকিশোর।
১৮৭৯ সালে বৃত্তিসহ প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন উপেন্দ্রকিশোর। প্রবেশিকা পাসের পর তাকে আর পায় কে! ময়মনসিংহ থেকে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুদিন পড়াশোনা করলেন। এরপর ১৮৮৪ সালে স্নাতক হলেন মেট্রোপলিটন কলেজ (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) থেকে।
হরিকিশোর কখনো উপেন্দ্রকিশোরের ওপর প্রচলিত রীতিনীতি চাপিয়ে দিতেন না। ফলে উপেন্দ্রকিশোর বেড়ে উঠেছিলেন তার খেয়ালি স্বভাব নিয়ে। যদিও উপেন্দ্রকিশোর চলাফেরা করতেন রাজা রামমোহন রায়ের ভক্ত-অনুসারীদের সঙ্গে। এরা সবাই ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের মানুষ। ওদিকে এমন খবর জেনে হরিকিশোর বেশ শঙ্কিত ছিলেন, তার ছেলেটা না আবার ব্রাহ্ম হয়ে যায়। বিচলিত পিতা চরমপত্র দিলেন পুত্রকে- ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলে উপেন্দ্রকিশোর তার সম্পত্তির কানাকড়িও পাবেন না।
ব্রাহ্মধর্মের প্রতি উপেন্দ্রকিশোরের আগ্রহ আরও বাড়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সান্নিধ্যে এসে। তার চেয়ে দুই বছরের বড় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে উপেন্দ্রকিশোরের। ব্রাহ্মরা মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতেন না, বর্ণপ্রথা মানতেন না। তাদের বাড়ির মেয়েদের স্কুলে যাওয়ায় বাধা ছিল না। পর্দাপ্রথারও ধার ধারতেন না।
পিতার সম্পত্তির থোড়াই কেয়ার করেন খামখেয়ালি উপেন্দ্রকিশোর। ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেন। খবর শুনে ভীষণ রেগে গেলেন হরিকিশোর। তার সম্পত্তির মাত্র এক-চতুর্থাংশ দিলেন দত্তকপুত্রকে। ফলে পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন উপেন্দ্রকিশোর।
তবে হরিকিশোরের মৃত্যুর পর এ উইল ছিঁড়ে ফেলেন হরিকিশোরের স্ত্রী ও নরেন্দ্রকিশোরের মা রাজলক্ষ্মী দেবী। পুত্রদের মধ্যে সম্পত্তি সমান ভাগ করে দেন তিনি।
১৮৮৩ সালে শিক্ষক প্রমদাচরণ সেনের ‘সখা’ পত্রিকায় ‘মাছি’
![](/storage/photos/150/33.jpg)
নামে একটা লেখা লিখলেন উপেন্দ্রকিশোর। ছোটদের সাহিত্যে প্রথম চলিত ভাষায় লিখলেন অনুবাদ প্রবন্ধ ‘নিয়ম ও অনিয়ম’। উপেন্দ্রকিশোরের চিন্তাভাবনা সবই ছিল শিশু-কিশোরদের নিয়ে। ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত হলো তার প্রথম বই, ‘শিক্ষক ব্যাতিরেকে হারমোনিয়াম শিক্ষা।’ সংগীতবিষয়ে তার দ্বিতীয় বইটি ওই একই জায়গা থেকে প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে। এটি ছিল বেহালা শিক্ষার বই।
১৮৯৭ সালে সিটি বুক সোসাইটি থেকে ‘ছেলেদের রামায়ণ’ নামে উপেন্দ্রকিশোরের লেখা ও অলংকরণ করা সচিত্র বই প্রকাশিত হলো। কিন্তু ছাপার মানে সন্তুষ্ট ছিলেন না লেখক। পৈতৃক জমি অনেকখানি বেচে দিয়ে সেই টাকায় বিলেতের পেনরোজ কোম্পানি থেকে বইপত্র, রাসায়নিক, ক্যামেরা, যন্ত্রপাতি আনিয়ে নিয়ে শুরু করলেন ছাপার উন্নতিসাধনের চেষ্টা। যাত্রা শুরু করল মুদ্রণসংস্থা ইউ রে আর্টিস্ট।
১৯০৩ সালে প্রাচীন পৃথিবী ও প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তুদের নিয়ে ছোটদের জন্য ‘সেকালের কথা’ প্রকাশিত হলো। ‘ছেলেদের রামায়ণ’ নতুন করে প্রকাশিত হলো ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে বের হলো ‘ছেলেদের মহাভারত’। ১৯০৯ সালে ‘মহাভারতের গল্প’। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় গ্রামবাংলার মা ঠাকুমাদের মুখে মুখে প্রচলিত বেশ কিছু গল্প একত্রে সংগ্রহ করে লেখা হলো ‘টুনটুনির বই।’ ১৯১০ সালে ছেলে সুকুমারকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে রাখলেন ইউ রায় অ্যান্ড সন্স। ১৯১১ সালে এই ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে বের হলো কবিতা আকারে ‘ছোট্ট রামায়ণ’।
১৯১৩ সালের গ্রীষ্মকালে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশিত হলো ছোটদের জন্য ঝকঝকে পত্রিকা ‘সন্দেশ।’ যা নিজস্ব মহিমায় আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে বাংলা শিশু সাহিত্যের আসরে। ১৯১৫ সালে গিরিডিতে ডায়াবেটিস রোগভোগে ওপারে পাড়ি জমানোর আগ পর্যন্ত সন্দেশের বত্রিশটা সংখ্যা সম্পাদনা করতে পেরেছিলেন। এই সন্দেশেই ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয় উপেন্দ্রকিশোরের শেষ উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম ‘গুপিগাইন বাঘা বাইন’।
১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭ বৈশাখ বা ১৮৬৩ সালের ১২ মে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামে তার জন্ম। সে হিসেবে জন্মসূত্রে তিনি বাংলাদেশি। আর মৃত্যুবরণ করেন ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে।
ছোটদের কথা ভেবেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী লিখেছেন। তার লেখার বিষয় নির্বাচন, রচনারীতি, পরিবেশনা, ভাষার ব্যবহার- এসব লক্ষ্য করলেই সহজেই সেটা বোঝা যায়। যদিও তার বেশির ভাগ লেখাই মৌলিক হিসেবে বলা যায় না, তবু তার পরিবেশনার মৌলিকত্ব তাকে দিয়েছে অমরত্ব। আর এই অমরত্বের কারণেই ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি বাংলার শিশুদের কাছেই শুধু নয়, বাঙালির কাছে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি অতি পরিচিত।