![এনবিআরের প্রতিবেদন: ছাড় কমানো হলে আদায়ে ঘাটতি থাকবে না](uploads/2024/07/04/nbr-bhaban-1720076799.jpg)
ছাড় বা অব্যাহতি কমানো হলে ভ্যাট আদায়ে ঘাটতি থাকবে না। বরং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আদায় হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পর্যায়ক্রমে ছাড় বা অব্যাহতি কমালেও অনেক খাতে এখনো ছাড় আছে।
এনবিআরে তৈরি একাধিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে ভ্যাট আদায়ের এ হিসাব দেওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বছরের পর বছর ভ্যাট ছাড় নিয়েও ব্যবসায়ীরা ভোক্তা পর্যায়ে আশানুরূপ সুবিধা দিতে পারেনি। নিজেদের পকেট ভারী করেছে। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর স্বার্থে ভ্যাট ছাড় কমানোর সুপারিশ করেছেন তারা।
এনবিআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ভ্যাট ছাড় ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। ২০২২ সালে যা ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। এনবিআরের সাময়িক হিসাবে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ভ্যাট ছাড় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার কম।
এনবিআরের আরেক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পর্যায়ক্রমে ভ্যাট ছাড় কমানো হচ্ছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে গতি আনতে এখনো অনেক খাতে ভ্যাট ছাড়ের সুবিধা বহাল রাখা হলেও ভ্যাট ছাড় যৌক্তিকীকরণের সময় এসেছে। ভ্যাট ছাড় যৌক্তিকীকরণ করা হলে দেশে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়বে।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভ্যাট ছাড় কমানো হলে ও সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায়সহ নিয়মনীতি পরিপালন করা গেলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আদায় করা যেত। কিন্তু ওই বছর আদায় হয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ভ্যাট গ্যাপ বা সম্ভাবনা ও আদায়ের মধ্যে ঘাটতি ছিল প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংক মনে করে, নীতিগত অবস্থানের কারণে ভ্যাট আদায়ে এমন ব্যবধান থেকে যাচ্ছে। নীতি ও বিধিবিধান পরিপালনের ব্যবধান কমানো গেলে অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আদায়ের সম্ভাবনা আছে। যেসব নীতি ও দুর্বলতার কারণে ভ্যাট আদায় হয়নি, তার মধ্যে আছে বড় অঙ্কের ভ্যাট ছাড়, ভ্যাট আদায় পদ্ধতিতে ফাঁকফোকর থাকা এবং নিয়মের অপর্যাপ্ত প্রয়োগ প্রভৃতি।
এনবিআরের এক প্রতিবেদনে সংস্থাটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রাহমাতুল মুনিমের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। চেয়ারম্যান বলেছেন, এনবিআরের প্রতিবেদনের আলোকে ভ্যাট ছাড় প্রক্রিয়ার যৌক্তিকীকরণ করতে পারবে। ন্যায্য ও স্বচ্ছ করব্যবস্থা প্রণয়নে এই প্রতিবেদনের ভূমিকা আছে। এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে যে কেবল রাজস্ব আদায় বাড়বে, তা নয়, বরং দেশের টেকসই উন্নয়নেও তা ভূমিকা পালন করবে।
এনবিআরের ‘বাংলাদেশ ভ্যাট ব্যয় প্রতিবেদন ২০২৩-২৪’ অনুযায়ী, ২০২২ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ২৫ শতাংশের সমান ভ্যাট অব্যাহতি পেয়ে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে কৃষি কার্যক্রমসহ খাদ্য ও পানীয় খাত। এরপর রয়েছে পোশাক ও পাদুকা খাত শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ, আবাসন খাত শূন্য দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে শূন্য দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং চিকিৎসাব্যয় শূন্য দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। সবচেয়ে কম ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা পেয়েছে শিক্ষা খাত, যা জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। অন্যদিকে গৃহস্থালি পণ্যে কোনো ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হয়নি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে জমা দেওয়া এনবিআরের ভ্যাটবিষয়ক এক প্রতিবেদন উল্লেখ আছে, বর্তমানে কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা সেবা খাতে কোনো ভ্যাট নেই। অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রাখে, এমন খাতগুলোতে ভ্যাট ছাড় রয়েছে। উৎপাদন খাতে পোশাকশিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি আছে।
মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোনসেট ও গৃহস্থালি সরঞ্জাম (হোম অ্যাপ্লায়েন্স) উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে এবং ক্ষেত্রে বিশেষে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠানগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভ্যাট ছাড় দেওয়া আছে। ওষুধের প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে এপিআই এবং সাবান ও শ্যাম্পুর প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনেও ভ্যাট ছাড় বা অব্যাহতি আছে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন পণ্য যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড এ জাতীয় পণ্য উৎপাদনে এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে একই সুবিধা আছে। পলিব্যাগের পরিবর্তে জিওব্যাগ ব্যবহার উৎসাহিত করতে কাঁচামাল হিসেবে পিপি ও পিপি স্ট্যাপল ফাইবার, রিসাইক্লিংয়ের লক্ষ্যে ওয়েস্ট পেপার/কটন/পুরাতন ব্যাটারি/স্ক্র্যাপ, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল ও ফটো-ভোল্টাইক, সেলে ভ্যাট অব্যাহতি আছে। পাইকারি/খুচরা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভ্যাট অব্যাহতি প্রাপ্ত। পরিবহন সেবায় একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পণ্য পরিবহন ও সাধারণ যাত্রী পরিবহনসংশ্লিষ্ট হওয়ায় ভ্যাটের আওতামুক্ত।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, অর্থনীতি গতিশীলতার স্বার্থে এখন ভ্যাট ছাড়ের যৌক্তিকীকরণ দরকার।
তবে সব খাতে যে একই হারে ভ্যাট ছাড় দেওয়া হচ্ছে, তা নয়। প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে যত ভ্যাট ছাড় দেওয়া হয়েছে, তার সিংহভাগই পেয়েছে খাদ্য ও পানীয় খাত। সেবার যে ভ্যাট ছাড় দেওয়া হয়েছিল, তা পরিমাণে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এর মধ্যে ২ দশমিক ২৫ শতাংশ দেওয়া হয়েছে খাদ্য ও পানীয় খাতে। অন্য খাতগুলোয় জিডিপির তুলনায় যে হারে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা এ রকম- পোশাক ও জুতা শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ, গৃহনির্মাণ ও বাড়িভাড়ায় শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ, জ্বালানি ও বাতিতে শূন্য দশমিক ০৮ শতাংশ, স্বাস্থ্যে শূন্য দশমিক ০৭ শতাংশ, শিক্ষায় শূন্য দশমিক ০২ শতাংশ ও বিবিধ খাতে শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ সবচেয়ে কম ছাড় দেওয়া হয়েছে শিক্ষা খাতে।