![এখনো প্রাসঙ্গিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্](uploads/2024/07/05/D-M-Shahidullah-1720161331.jpg)
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বাস্তবতার প্রেক্ষিতে অনেক মনীষী অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেও বাঙালি জাতির কৃতীসন্তান জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এখনো আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। শুরু করা যাক শহীদুল্লাহ্র অমর উক্তি দিয়ে। ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙালীত্বের এমন ছাপ এঁকে দিয়েছেন যে মালা তিলক টিকিতে বা টুপি লুঙ্গি দাঁড়িতে তা ঢাকবার জো নেই’। এমন কথা যিনি বলেন তিনি যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এখানেই বর্তমানের বাস্তবতায় তিনি হয়ে ওঠেন বাতিঘর। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে এখনো মোহাচ্ছন্ন বাঙালি জাতি। একদল পোশাকে ও ভাষায় নিজেদের মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তানের নাগরিক প্রমাণ করতে ব্যস্ত। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক সবকিছুই তাদের কাছে ‘নাপছন্দ’, ‘বেশরিয়তি’। আবার অন্যদল বাংলাভাষায় স্বাভাবিক গতিতে চলে আসা বহুল প্রচলিত আরবি, ফার্সি শব্দগুলোকে পর্যন্ত বর্জন করে বারো শ শতকের আগের জীবনে ফিরে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ১৯৪৭ সালে দ্বিধাবিভক্ত বাঙালি জাতি এখন বহু খণ্ডে, বহু ভাগে বিভক্ত। এই সময়েই প্রয়োজন শহীদুল্লাহ্র আদর্শ যিনি প্রমাণ করেছেন নিজের ধর্ম বিশ্বাসে নিষ্ঠাবান হয়েও অপরাপর ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া যায়। যিনি মাতৃভাষা বাংলাকে সর্বোচ্চ ভালোবেসেও সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি ভাষায় তো বটেই সুপণ্ডিত হয়েছেন ১৮টি ভাষায়। বলতে ও লিখতে শিখেছেন ২৭টি ভাষা, গবেষণা করেছেন ৪০টি ভাষা নিয়ে।…
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন একই সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ এবং ব্যক্তি জীবনে নিষ্ঠাবান ধার্মিক। তিনি বলেছিলেন, ‘হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাঙালি জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতেই হউক না কেন, তাহা তো করিতেই হইবে। বাঙালি হিন্দু বাঙালি মুসলমান ব্যতীত চলিতে পারিবে না। বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দু ব্যতীত চলিতে পারিবে না। চিরকাল কি একভাবে যাইবে? জগতের ইতিহাস পৃষ্ঠে কি হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালি জাতি, ফরাসি, ইংরেজ, ইতালিয়ান, জার্মান, জাপানি প্রমুখ জাতির ন্যায় নাম রাখিতে পারিবে না? আশা কানে কানে গুঞ্জন করিয়া বলে পারিবে। (বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মিলনীর দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ, ১৯২৮)।
তার একান্ত আশা ছিল ভবিষ্যতে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান মিলিত বাঙালি জাতি বিশ্বসভায় ফরাসি, জার্মান জাতির মতো সম্মানজনক স্থান অধিকার করবে।
তিনি সংস্কৃত, প্রাচীন পাহ্লবি, আররি, হিব্রু, খোতনি, তিব্বতি, পালি ইত্যাদি ভাষা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি নিয়ে এবং চর্যাপদ নিয়ে মূল গবেষণা করেছিলেন। তার মতে, বাংলাভাষার উৎপত্তি হলো গৌড়ীয় বা মাগধী প্রাকৃত থেকে। বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা নয়, তবে নিকটাত্মীয়। তিনি মনে করেন বাংলা ভাষার উৎপত্তি কাল সপ্তম শতাব্দী। তার পাণ্ডিত্যের মূল বিষয় ছিল তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব। আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত ইত্যাদি তার অমর অবদান। তিনি উর্দু অভিধানও প্রণয়ন করেছেন এবং শ্রীলঙ্কার ভাষার উৎপত্তিও নির্ধারণ করেছেন।
তিনি ১৮টি ভাষায় সুপণ্ডিত হলেও গভীরভাবে ভালোবাসতেন বাংলাভাষাকে। বাংলাভাষাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই ছিলেন সোচ্চার।
তিনি ১৯৪৭ সাল থেকেই এ বিষয়ে জোরাল দাবি উত্থাপন করছিলেন বিভিন্ন প্রবন্ধে ও ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা
বাংলা না হয়ে উর্দু বা আররি হলে তা হবে গণহত্যার শামিল। তিনি পাকিস্তান সরকারের সব ধরনের ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষার পক্ষে তার সংগ্রাম চালিয়ে যান।
তিনি ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের জন্য ছিলেন প্রধান প্রেরণা। একুশে ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের পর তিনি প্রথম কালো ব্যাজ ধারণ করেন। তার দুই ছেলে মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ও মুর্তজা বশীর দুজনেই ভাষাসৈনিক ছিলেন। কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ছিলেন ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও কর্মী। আর মুর্তজা বশীর ছিলেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের (তকীয়ূল্লাহ তখন জেলখানায় রাজবন্দি ছিলেন) অন্যতম প্রধান কর্মী।
১৯৫০ সালের যখন পাকিস্তান সরকারের মদদে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় তখন তিনি নিজের বাড়িতে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন মানুষকে আশ্রয় দেন। শুধু তাই নয়, তিনি চক বাজারের জামে মসজিদে জুমার দিন বক্তৃায় বলেন, যদি কেউ কোরআন শরিফ থেকে প্রমাণ করতে পারেন যে, নিরপরাধ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যার বিধান রয়েছে তাহলে তিনি নিজের নাম পাল্টে ফেলবেন। তিনি তার বাড়িতে আশ্রয়কেন্দ্র খোলার ঘোষণা দিয়ে বলেন, পারলে আমাকে প্রতিরোধ কর। তার এই বলিষ্ঠ বক্তব্যের পর চকবাজারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেমে যায়।
মহান ভাষা আন্দোলনে শহীদুল্লাহ্র ভূমিকা ছিল দার্শনিক ও শিক্ষকের। আর এখানেই তিনি এখনো প্রাসঙ্গিক। বাংলাভাষার ওপর আগ্রাসন এখনো কিন্তু থেমে যায়নি। পশ্চিম বাংলায় হিন্দির দাপটে বাংলা কোণঠাসা। বাংলাদেশে ভাষার বিকৃতি, মিশ্র ভাষা, ইংরেজি মাধ্যম ও আরবি মাধ্যমের জাঁতাকলে পিষ্ট বাংলাভাষা। ইংরেজি হরফে বাংলা লেখার প্রবণতা এখন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে চলছে, যা বাংলা বর্ণমালার ওপর একটি আঘাত। প্রমিত বাংলাকে বিকৃত করে বলার প্রবণতাও বিধ্বংসী। এসব থেকে বেরিয়ে বাংলাভাষাকে সত্যিকারের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এখন দরকার শহীদুল্লাহ্র আদর্শকে সামনে তুলে ধরা।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র জীবনী আবার স্কুলের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাই। মা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমির প্রতি জাতিকে শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে শহীদুল্লাহ্র আদর্শের কোনো বিকল্প নেই। ১০ জুলাই জন্মদিবস এবং ১৩ জুলাই মৃত্যু দিবসে প্রথা মেনে স্মরণ শুধু নয়, প্রয়োজন আমাদের জাতীয় জীবনে শহীদুল্লাহ্সহ আরও অনেক বাঙালি চিন্তাবিদ ও মনীষীর আদর্শকে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা।
লেখক: ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পৌত্রী, ভাষাসৈনিক কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর কন্যা