![কারবালা উপাখ্যান: ইতিহাসের রক্তক্ষরণ কিংবা শিল্প ও সত্যের যাপন](uploads/2024/06/28/karbala-Upakkhan-1719556411.jpg)
খেলাফতের উত্তরাধিকার নিয়ে মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন ও ইয়াজিদের মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনা মানব ইতিহাসের অন্যতম একটি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসেবে বিধৃত ও স্বীকৃত। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া ওই প্রতারণামূরক যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাত এখনো বিদ্যমান। মুসলিম বিশ্ব এখনো দ্বিধাবিভক্ত। এখনো ওই ঘটনা স্মরণ করে মুসলিম সম্প্রদায় ব্যথিত ও কাতর হন।
প্রায় দেড় হাজার বছর আগের সেই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল লিখলেন নতুন উপন্যাস কারবালা উপাখ্যান।
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে হাজার হাজার গ্রন্থ লেখা হয়েছে। ফিকশন, নন-ফিকশন, ইতিহাস, গজল, মর্শিয়া, আখ্যান আরও নানা ধরনের রচনা। ইতিহাসের অংশ হিসেবে এই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে নানাভাবে। মুসলিম বিশ্ব এবং অমুসলিম বিশ্ব বিভিন্ন প্রক্ষেপণে আলো ফেলে বোঝার চেষ্টা করেছে এই যুদ্ধের কারণ, গতিপ্রকৃতি এবং অভিঘাত। তবে সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো এই ঘটনা নিয়ে খোদ মুসলিম বিশ্বে এখনো দ্বিধা-বিভক্তি চলমান। রয়েছে অতিরঞ্জন। এসবের ভিড়ে মূল ইতিহাস এবং এর আসল প্রবাহ বের করা খুবই কঠিন।
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে শত বছর আগে বাংলাভাষায় বিষাদ সিন্ধু নামে উপন্যাস লিখেছিলেন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন। মুসলিম লেখকদের মধ্যে লেখা এ উপন্যাসটিকেই প্রথম সার্থক উপন্যাস হিসেবে গণ্য করা হয়। বিপুল পঠিত ও সমাদৃত হয় এ উপন্যাস। এমনকি বাঙালি মুসলমান এই গ্রন্থটিকে ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবেও মর্যাদা দিয়ে এসেছে এর প্রকাশের পর থেকে আজ অব্দি। মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেক বাড়িতেই দেখা গেছে ধর্মীয় গন্থের সঙ্গে বিষাদ সিন্ধুর একত্র সমাবেশ।
প্রশ্ন হলো, একুশ শতকে এসে এরকম একটি উপন্যাস লেখার উপযোগিতা কী? যে ঘটনা বহুশ্রুত, জ্ঞাত, উল্লিখিত, বর্ণিত, চর্চিত। সে-ঘটনা নিয়ে কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল কেন নতুন করে আরেকটি উপন্যাস লিখতে বসলেন। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে কারবালা উপাখ্যানের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। শুধু এর কাহিনি নিয়ে নয়, এর কাঠামো, ভাষা, উপস্থাপন নিয়ে কথা বলতে হবে।
প্রথমে আমরা এর কাহিনির দিকে তাকাই। আমার সঙ্গে হয়তো-বা অনেকেই দ্বিমত করবেন না এই বিষয়ে যে, বর্তমান সময়ে আমরা এক ধরনের তথ্যের নৈরাজ্যের মধ্যে বসবাস করছি। একসময় আমাদের তথ্যের অপ্রতুলতা ছিল ব্যাপক। এরপর তথ্যের অপ্রতুলতা ঘুচলেও স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের কারণে তথ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপতথ্য। যুক্ত হয়েছে অর্ধসত্য। ফলে এখন চলেছে তথ্যের নৈরাজ্য। এখন কোনো তথ্য পাওয়ার পর সেটা ফ্যাক্টচেক না করে গ্রহণ করলে গোলমাল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
কারবালার ঘটনাও এর ব্যতিক্রম নয়। কোন তথ্য ঠিক, কোনটা বেঠিক, কোনটা অর্ধসত্য, কোনটা অপতথ্য তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যেতে হয়। কারণ একেক উৎসে একেক ধরনের তথ্য। এমনকি পরস্পর বৈপরীত্যও লক্ষ্যণীয় সেসব তথ্যে। কারবালার ঘটনা নিয়ে এরকম ঘটার কারণ হলো বিভিন্ন মতাদর্শ। বিভিন্ন ধরনের মত বা থিওরি প্রয়োগ করার জন্য যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় তার অনুসারী বাড়ানোর জন্য ইচ্ছেমতো ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তা করা হয় নিজেদের হীন স্বার্থে। এর মধ্য থেকে নির্ভেজাল ইতিহাস বের করে আনা সাধারণের পক্ষে কঠিন।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল কঠোর পরিশ্রম করে নির্ভেজাল ইতিহাসের আলোকে লিখেছেন এ উপন্যাস। ফলে বলতেই পারি- সাধারণের পক্ষ্যে যা কঠিন লেখক তা সহজ করে দিয়েছেন। অপতথ্য আর অর্ধসত্যের ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন এই সময়ে সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে লেখা এ উপন্যাসকে তাই সময়ের সঠিক দিশারি বলা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, কারবালা উপাখ্যানের কাঠামো, বর্ণনা ও ধারাবাহিকতা। এ ক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভালো যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের একটি বড় গুণ হলো আবেগ বিবর্জিত হওয়া। কিন্তু কারবালার ঘটনা এতই মর্মান্তিক যে, একজন মুসলমান হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে এই ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত ও আবেগাপ্লুত হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কারবালার ঘটনা মূল ঘটনা থেকে বিচ্যুত হওয়ার এটাও একটা কারণ। লেখকও তো মানুষ। কাজেই কারবালার ঘটনায় আবেগাপ্লুত হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল এখানে খুব সংবরণের পরিচয় দিয়েছেন; যা কারবালা নিয়ে লিখতে গিয়ে অধিকাংশ লেখকই ব্যর্থ হন। তারা ইতিহাসের অংশে আবেগ নিয়ে প্রবেশ করায় মূল জিনিস থেকে বিচ্যুত হয়ে যান। মোস্তফা কামালের লেখকসত্তা এখানে ব্যক্তিসত্তাকে ছাপিয়ে গভীরতা ও সত্যসন্ধানী পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে উঠেছে। তাতে কী হয়েছে? তাতে ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে, অযাচিত আবেগের হাত থেকে উপন্যাসটি রক্ষা পেয়েছে। আর পেরেছে ইতিহাসগ্রন্থ না হয়ে উঠতে। হয়ে উঠেছে উপন্যাস।
ইতিহাস বিকৃতি থেকে মুক্ত হওয়া, তথ্যের বিকৃতি না করা, ইতিহাসের পরম্পরা থেকে হঠাৎ বিচ্যুত না করা, অহেতুক ভাবালুতায় আক্রান্ত না হওয়া এবং আবেগবর্জিত হওয়ার দরুণ কারবালা উপন্যাসের ভাষা হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক তরতরে। আরও সহজ করে বললে বলতে হবে- একুশ শতকীয়। অর্থাৎ একুশ শতকীয় ভাষায় প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের অন্তরে-বাহিরে ভ্রমণ করার সুযোগ।
শুধু তাই নয়, ওই সময়ের, ওই দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর যে রূপ তা এই সময়ে এই দেশের কাঠামোর অনুরূপ নয়। লেখক ঘটনার অভিঘাত ও পরম্পরা বোঝানোর জন্য ওই কাঠামোগুলো তাদের আদিরূপে দেখাননি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নিরাপত্তার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। আমরা যাদের আমাদের দেশের এই একুশ শতকীয় ভাষায় পুলিশ, গোয়েন্দা ইত্যাদি নামে অভিহিত করে থাকি। কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল ওই সময়ের শৃঙ্খলা-কাঠামো বোঝাতে গিয়ে ওই সময়ের পদ-পদবি উল্লেখ করেননি। করেছেন এই সময়ের আলোকে। ফলে পাঠকের পক্ষে ঘটনার গভীরে প্রবেশ করে চরিত্রের গতিবিধি লক্ষ্য করে কার কী ক্ষমতা ও ভূমিকা তা সহজেই অনুধাবন করতে পারে। একটি উপন্যাসের সঙ্গে মনো-সংযোগের এই উপাদান মোস্তাফা কামাল খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন।
আবেগের অতিশয্য নেই, ভাষার কচকচানি নেই, ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেওয়ার জন্য কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশ নেই, কাউকে মহান বানানোর গোপন অভিসন্ধি নেই, কাউকে ছোট করার নির্লজ্জ অভিপ্রায় নেই। এরকম নির্মোহ হয়ে লিখেছেন মোস্তফা কামাল।
ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার কিছু ঝুঁকি থাকে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে যখন চরিত্রগুলো বাস্তব হয়। ঐতিহাসিক উপন্যাসের মূল উপাদান যদি শুধুই সময় হয়ে থাকে, এবং শুধু সময়কে ধারণ করার অভিপ্রায় থেকে লেখক লিখতে চান তাহলে তার ঝুঁকি কম। সাধারণ চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে সময়ের অভিপ্রায় ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তার রেখে যাওয়া ছাপ ও অভিঘাত তুলে ধরার জন্য তিনি ইচ্ছেমতো কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশ ঘটাতে পারেন। কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাসের মূল উপাদান যদি ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে থাকে তাহলে ঝুঁকি অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে সময় অবধারিতভাবেই নির্দিষ্ট। আগের অবস্থায় চরিত্র ছিল অনির্দিষ্ট। এ ক্ষেত্রে চরিত্রগুলো নির্দিষ্ট, ঐতিহাসিক, সুপরিচিত, সুবিদিত এবং বহুল চর্চিত। এরকম চরিত্র নিয়ে, জানা ঘটনা নিয়ে, বহুল চর্চিত বিষয় নিয়ে ফিকশন লেখা সহজ কথা নয়। বলা বাহুল্য, এ ধরনের রচনার সবগুলো উপাদানই হলো নন-ফিকশনাল কিন্তু লেখক লিখতে বসেছেন ফিকশন। চরিত্রের প্রকৃত রূপ ঠিক রেখে এ ধরনের বিষয় নিয়ে ফিকশন লেখা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এই দুঃসহ-ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে অনেক মেধার প্রয়োজন হয়।
লেখক মোস্তফা কামাল এই ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুঃসহ কাজটি নিজ দায়িত্বে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এই গুরুদায়িত্ব তাঁকে দিয়ে যে মহান কাজটি করাল তাতে কয়েকটি কাজ সাধিত হলো। যেমন, বাংলা সাহিত্য একটি উপন্যাস পেল। যে উপন্যাসে তথ্যের কোনো নৈরাজ্য নেই, আবেগের বাহুল্যতা নেই, কাউকে বড়ো করে দেখানোার কপট মাহাত্ম্য নেই, কাউকে ছোট করে দেখানোর নির্লজ্জ কপটতা নেই, ইতিহাসের মোড় ঘুড়িয়ে দেওয়ার গোপন অভিসন্ধি নেই, সর্বোপরি ইতিহাসের উপাদান নিয়ে কপট ধর্ম প্রচার নেই। তিনি আসলে ফিকশন রচনা করতে চেয়েছেন। আর তাতে ইতিহাসের সত্য, যাপনের সত্য, চরিত্রের সত্য ও ক্ষমতার চরিত্র নিয়ে দেখাতে চেয়েছেন ইসলামের এক নাজুক সময়কে।
পাঠক যদি নির্ভেজাল তথ্যের আলোকে ওই সময়টাকে যাপন করতে চান, মর্মোদ্ধার করতে চান ওই সময়ের চরিত্রের, তাহলে এ উপন্যাসের সঙ্গে যাপন করতে পারেন। সে-যাপন শিল্প ও সত্যের আলোকে আলোকিত হয়ে উঠবে।
কারবালা উপাখ্যান
লেখক: মোস্তফা কামাল
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪
সময় প্রকাশন
প্রচ্ছদ: মেধা রোশনান সারওয়ার
মূল্য: ৪৬০ টাকা