![অমিত সুখ](uploads/2024/07/05/amito-sukh-1720163021.jpg)
ভাত দেও না ক্যা?
কী দিয়া দিমু? ঘরে ভাত আর নুন ছাড়া ত খাওনের কিছুই নাই।
একটা ডিমও ভাইজা দিতে পারবা না?
থাকলে ত দিমু।
বেহানবেলা মনডাই খারাপ হইয়া গেল। কী দিয়া যে কী করুম। মাইনষের তে টাকা ধার করতে করতে এহন নতুন কইরা চাইতে শরম করে।
ক্যা, নদীর কামাই নাই? নদীত মাছ পড়ে না?
কামাই আর কই? নদীত যাইয়া কী করুম? মাছ নাই। জালে পড়ব কী? জালে এহন আর মাছ ওডে না।
ঠিকই কইছেন। নদীত মাছের থেইক্কা জাইল্লা বেশি। মাছ বড় না অইতেই বেবাক ধইরা লইয়া আহে। জাইল্লাগো লাইগা মাছ বড় অইতে পারে না।
আইচ্ছা, থাহো দেহি ঘরে। আমি গেলাম। দেহি কিছু করবার পারিনিহি।
আইচ্ছা দেহেন।
কাসু মাঝি ছয় মাস হয় বিয়ে করেছে। বউ এখনো পোয়াতি হয়নি। কী সুন্দর চেহারা। গরিব ঘরের মেয়ে। বিয়ের সময় রহিমার সঙ্গে বেশিকিছু দিতে পারেনি আজগর মাঝি। তবে রহিমার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকার অলংকার দিয়েছে। ঘরের আসবাবপত্র দিয়েছে পঞ্চাশ হাজার টাকার। মোট এক লাখ টাকার বরাদ্দ রেখেছে আজগর মাঝি। মেয়েকে সুখী দেখার জন্য আজগর মাঝি এনজিও থেকে কিস্তিতে ঋণ নিয়েছে। ঘরে এখনো বিয়ে দেওয়ার মতো দুই মেয়ে রয়েছে আজগর মাঝির। কোনো ছেলে নেই। তাই কাসুকে নিজের ছেলের মতোই মনে করে সে। আজগর মাঝি দোকানে বসা। পাশ দিয়ে কাসু যেতেই-
বাবা কাসু, কই যাও?
আস্সালামুআলাইকুম। নদীর পাড় যামু।
ক্যা?
কাম আছে।
নদীত জাল বাও না?
না।
ক্যান?
নদীত মাছ থাকলে ত জাল বামু। হারা দিন ভাগিদার লইয়া খাইটা পাঁচ-দশটা মাছ পাইলে নিজে রাখুম কী আর ভাগিদারগোরে দিমু কী। হের পরে মাহাজনের দেনা ত আছেই।
কথা খারাপ কও নাই। হগলেই এই কথা কয়। আমি নদীত জাল বাওয়া ছাইড়া দিছি। তয় আডে-বাজারে গেলে কইতে পারি মাছের কী দাম।
আমি আহি আব্বা।
কাসু নদীর পাড়ে গিয়ে এক ধ্যানে বসে থাকে। নদীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। নদীর মাঝ পথ ধরে তেলের জাহাজ ধীরে ধীরে চলতে থাকে। মাছ ধরার ট্রলার দেখা যায় খুব কম। কাসু হঠাৎ উঠে দাঁড়াতেই বাল্যবন্ধু ফজলু কাসুর সামনে এসে দাঁড়ায়।
কী রে কাসু, এইহানে কী করতাছত?
কী আর করুম। নদীরে ভালা কইরা দেখতাছি। নদী আমাগোরে পেটে লাথি মারছে। খাওন দেয় না।
হেই কথা কইয়া লাভ নাই। নদীত আগে কত রহম মাছ পড়ত। এহন এক ইলিশ মাছ। তাও আবার ছোডখাডো। বাজারে নিলে কয় জাটকা। ধরতে গেলে সরকারি বাহিনীর লগে কত দইছই।
দইছই ত করবই। অগো বাপের টাকা দিয়া জাল কিনি ত। হের লাইগা আমাগো জাল পোড়াইয়া দেয়।
আসলে হালারা বড় ডাকাইত। ফজলু বলে।
ল দেহি, আচমত চাচায় জাল বোনতাছে। হেইয়ানে জামু।
ল যাই।
কাসু ও ফজলু আচমত মাঝির কাছে যায়। আচমত মাঝি তার দুই ছেলে নিয়ে জাল বুনে। সেখানে তারা সুখ-দুখের আলাপ করে। আলাপ করতে করতে বিকেল হয়ে যায়। কাসুর রহিমার কথা মনে পড়ে। ঘরে কেউ নেই। রহিমা একা ঘরে থাকবে কেমন করে- ভাবতে ভাবতে বলে- ল ফজলু, মেলা বেলা হইয়া গেছে। তর ভাবি ঘরে একলা। যাইতে হইব।
ক্যা, ভাবিরে কী কেউ লইয়া যাইব?
আরে কী কছ!
যা যা হক্কাল কইরা যা।
ফজলু কাসুরে ছাইড়া দে। ঘরে নতুন বউ। আচমত মাঝি বলেন।
কাসু বলে- হ চাচা, বাড়িত যাইতাছি। তয় আপনের লগে একটু কথার কাম আছে।
কও বাবা।
আমারে কয়ডা টাকা দেওন যাইব? নদীত নামলেই টাকা শোধ কইরা দিমু।
আইচ্ছা। তয় কত টাকা লাগব তর?
তিন হাজার টাকা দিলে ভালা অয়।
নেও। তয় সময়মতো শোধ কইরা দিবা, বাবা।
আপনে চিন্তা করবেন না, চাচা। টাকা আপনে পাইয়া যাইবেন।
কাসু টাকা পেয়ে খুশি মনে হাঁটতে থাকে। বাজারে গিয়ে চাল, ডাল, তেল ও গুড়ের জিলাপি ক্রয় করে ইজি বাইকে চড়ে বাড়ি যায়। বাইক থেকে নেমে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ঘরের সামনে গিয়ে বলে, রহিমা দরজা খোল।
ক্যাডা?
আরে তোমার স্বামী কাসু মাঝি।
এমন কইরা কন ক্যা? শরম লাগে না।
এহন আর শরমের কাম কী। তুমি আমার পরান পাখি। কে কী কইব আমার তাতে কী যায় আহে। ব্যাগ ধরো, বাজারে গেছিলাম।
আহেন। ঘরে আইয়া পড়েন।
হোন বউ। বিয়ার আগে বাবার লগে মাছ ধরছি নদীত। কত মাছ যে পাইছি। আর এহন...।
পাইবেন। পাইবেন। আবার মাছে আপনার নাও ভইরা যাইব।
মাছ পামু কইত্তে? মানুষ গেছে হারমাইদ হইয়া। কেউ হাচা কথা কয় না। বুঝলা বউ, বিশ্বাস! বিশ্বাস হারাইয়া গেছে।
তয় যান, মুখ-হাত ধুইয়া আহেন। পাশের ঘরের থেইকা পিডা দিয়া গেছে। খাইতে দিমু।
ক্যাডা দিয়া গ্যাছে?
চাচি আম্মা।
হোন বউ, আইজ রাখছ ভালা কথা। কাইল তনে দিলে আর রাখবা না।
ক্যা?
বোঝবা না। তুমি বোঝবা না। আমি তহন ছোড। আমার মা-বাবায় মরার পরে অরা আমারে অনেক কষ্ট দিছে। চাচি আমারে মাইরা ফালাইতে চাইছে। আল্লায় আমারে বাঁচাইয়া রাখছে।
কী কন?
হ। ঠিকই কইছি। বাপ মরার পরের তন আল্লায় আমারে অনেক টাকা দিছে। নদীত নামলেই মাছ পাইছি। মেলা মাছ। টাকা আর টাকা। আমার টাকা দেইখা চাচির মাইয়া আঞ্জুরে আমার লগে বিয়া দিতে চাইছে।
হের পর?
হের পর আর কী। আমি না কইয়া দিছি। এহনো আমার পিছনে লাইগা রইছে। পারলেই ছোবল দিতে চায়।
আপন চাচিও এমন হয়?
হয়। হয় বউ।
বাদ দেন ওইসব কথা। আপনে পিডা না-খাইলে ঘরে মুড়ি আছে। গুড় দিয়া মাইখা খান।
হ। তাই দেও। হেইডাই ভালা।
রহিমা বাজার থেকে আনা সওদাগুলো একে একে গুছিয়ে রেখে টিনের পাত্র থেকে মুড়ি ও গুড় নিয়ে কাসুর সামনে দেয়। কাসু অপলক দৃষ্টিতে রহিমার দিকে তাকিয়ে থাকে-
বউ তুমি খাইবা না?
আপনে খান।
তুমি কিছু খাইছ?
আপনে খাইলেই ত আমার খাওন।
এইডা কোনো কথা? তোমার খিদা লাগে নাই বুঝি?
বিনা কামে থাকলে আমাগো খিদা। কামে কামে থাকলে আমাগো খিদা লাগে না।
তোমার কথা হুইনা আমার একটা কথা মনে পইড়া গেল।
কী কথা?
আমার মায়ও এমন আছিল। বাবায় কত কইত খাইয়া লও। হের পরে কাম কইর। কে হোনে কার কথা? মায় না-খাইতে না-খাইতে একদিন ক্যান্সারে মইরা গেল। টাকার অভাবে মায়েরে ভালা ডাক্তার দেখাইতে পারি নাই। আইজ মায়ের কবরের ওপরে কত গাছ। ফলও ধরে। পাখিয়ে খায়। মাইনষেও খায়।
আমার মনে অয় আপনের মায় আপনেরে দোয়া দিয়া গেছে। আবার আপনে আগের দিন ফিরা পাইবেন।
ঠিকই কইছ বউ। হেইডাই যেন অয়। যাও হক্কাল হক্কাল রান্দনবারণ সাইরা লাও।
কাসু মাঝি গুড় দিয়ে মুড়ি মেখে খেয়ে চকির ওপর শুয়ে পড়ে। মাথার ওপর টিনের চালের মাঝে মাঝে ফুটো হয়ে আছে। ফুটো দিয়ে চাঁদের জোছনা চুয়ে চুয়ে পড়ে। ফুটোতে চোখ পড়তেই কাসু মনের সুখে গান ধরে-
টাকা পয়সায় নাইরে সুখ
বুকের মইধ্যে ভীষণ দুখ
সুখপাখিটা উইড়া গেছে দূরে...। কণ্ঠে গান থাকতেই বিল্লাল মাঝি
ফোন দেয়।
কাসু ফোন ধরে। ফোনে শুধু জে জে করতে থাকে কাসু। কথা শেষে বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে।
রহিমা খাওন হইছে?
আর একটু। অহনেই খাওন দিমু।
দেও। দেও। তয় হোন ভালা খবর আছে।
রহিমা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে বলে, কী খবর?
খবর আছে বউ। কাইল শ্যামরাজ যামু।
কই যাইবেন?
শ্যামরাজ।
এইডা আবার কোনহানে?
ক্যা, আমাগো ভোলার দক্ষিণে। হেনে অনেক মাছ পাওয়া যায়। আমাগো দিন ফিইরা যাইব।
হ। দেহেন। আল্লায় যেন আমাগো দিন ফিরায়। এহন কি কেউ গরিব আছে। ঘরে ঘরে বড়লোক। সবাইর ঘরেই টাকা। সবারই হাতে হাতে মোবাইল। দেশে চাউল-ডাইলের অভাব নাই।
ঠিকই কইছ বউ। শুধু আমাগো ঘরেই অভাব।
আপনে চিন্তা কইরেন না। আল্লায় দিলে কতক্ষণ। আপনে বহেন। আমি খাওন আনতাছি।
যাও।
কাসু রহিমাকে নিয়ে মনের আনন্দে তৃপ্তিসহকারে রাতের খাবার খায়। খাওয়ার মধ্যেই কাসু রহিমার দিকে থেকে থেকে চেয়ে থাকে। রহিমা কাসুর দিকে তাকিয়ে লজ্জা পায়।
খাইতে বইয়া আমার দিকে চাইয়া থাকলে হইব?
না। তয় তোমারে এত সুন্দর লাগতাছে। কইয়া বুঝাইতে পারুম না।
কী যে কন। আগে খাওন শেষ করেন।
রহিমার কথায় কাসুও একটু লজ্জা পায়। তাড়াতাড়ি খাবার খাওয়া শেষ করে বিছানায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তারপর দুজনেই শুয়ে পড়ে বিছানায়। সুখ-দুখের কথা বলে-
দেহ বউ, বেহানে ঘরে খাওনের কিছু আছিল না। এহন দুজনে পেট ভইরা ভাত খাইছি। সবই আল্লার ইচ্ছা।
ঠিকই কইছেন। হারা দিন টাকা টাকা করলে ঘরে সুখ আহে না।
ঠিক কইছ। তোমারে বিয়াকরণের সময় আমার শ্বশুর তোমার গলায় আর কানে পঞ্চাশ হাজার টাকার স্বর্ণ দিছে। ঘরের মালামাল দিছে। কত টাকা খরচা হইছে। সবই ত বেইচা নাওয়ের পিছনে দিছি। তোমারে স্বর্ণ ফিরাইয়া দিতে পারি নাই।
মাছ বেইচা টাকা অইলে কিন্না দিয়েন।
হ বউ, আমার ইচ্ছা আছে। তয় তুমি ঠিকই কইছ। মাইনষে মাছ ধইরা বেইচা বেইচা কত টাকার মালিক হইয়া যাইতাছে। আমার বেলায় এমন ক্যা?
এই কথা কইয়েন না। আল্লায় ভালা জানে।
আমাগো ঘরে পোলা-মাইয়া আইব। আমরা বাপ-মা অমু। আমার যে কী খুশি লাগতাছে।
আপনের মুখে না কিছু আটকায় না।
খারাপ কী কইলাম?
না, ভালাই কইছেন।
জানো বউ, আমি লেদাকালের তন দুঃখে দুঃখে মানুষ অইছি। শান্তি দেহি নাই। চাচার সংসারে বড় অইছি। আমারে ওরা কথায় কথায় মারছে। স্কুলে যাইতে পারি নাই। অনেক কষ্টে থ্রি পর্যন্ত পড়ছি। আমার ইচ্ছা আল্লায় আমারে পোলা দিলে ওরে আমি লেহাপড়া হিগামু।
মানুষ করুম। দেহো বউ, আমাগো বিছানায় চান্দের আলো ঝরতাছে। টিন ফুটা হইয়া গেছে। এইবার নদীত মাছ পাইলে বেইচা চালে নতুন টিন লাগামু।
হ, তাই কইরেন।
তোমার লাইগা একটা লাল শাড়ি আনুম। নতুন শাড়ি পইরা ঠোঁটে রং লাগাইবা। আমি দেহুম। সাজলে যে তোমারে কী সুন্দর লাগে। বিয়ার রাইতে তোমারে কী যে সুন্দর লাগছিল কইয়া বুঝাইতে পারুম না।
আপনের ভালা লাগলে আমি সাজুম। আপনে আমারে মন ভইরা দেখবেন।
হ, এহনই ত আনন্দ। বুকের লগে বুক লাগাইয়া দুজনে এক হইয়া যামু। ভাসতে থাকুম সুখের সাগরে।
আপনেরে এত সুন্দর সুন্দর কথা হিগাইছে ক্যাডা?
হিগান লাগে না। মনের মইধ্যে আগেই জমা আছিল। কইতে পারি নাই। আইজ মনডা ভালা। হের লাইগা তোমার লগে সুখ-দুখের আলাপ করতাছি।
জানেন, বিয়ার আগে আপনে যহন আমাগো বাড়ির পাশে দিয়া যাইতেন তহন আমি আপনেরে চাইয়া চাইয়া দেখতাম। আর মনে মনে কইতাম- আহা রে মানুষডা দেখতে কী সুন্দর! আমি যদি জীবনের লাইগা পাইতাম তারে। ঠিকই আল্লায় আপনেরে আমার লাইগা পাওয়াইয়া দিছে।
আমিও মণ্ডলের দোকানে বইয়া বইয়া যহন টিভি দেখতাম তহন মনে মনে ভাবতাম- আমার যদি সুন্দর একখান বউ হইত। তোমারে পাইয়া আমি খুশি। আমারে ছাইড়া যাইবা না, কও বউ?
যামু না। যামু না। হুনছি গরিবের মাইয়ারা স্বামী ছাইড়া যায় না। গরিবের সংসারে অনেক শান্তি।
ঠিকই কইছ। আমাগো টাকা না থাকতে পারে। সুখের অভাব নাই। আমরা রাইতে ঘুমাইয়া যেই শান্তি পাই, বড়লোকেরা হেই সুখ পায় না।
বউ তুমি আমার আরও কাছে আহো। আমার পরানের মইধ্যে তোমারে আদর কইরা রাহি। রাইতটা বড় সুখের লাগতাছে।
আমি আপনের পরানের মইধ্যে ডুইবা গেছি। আমারে সুখ দেন। সুখের সাগরে ডুইবা যাইতে চাই আমি।
কাসু মাঝি ও রহিমা সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যায় অনেক দূরে। ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে ঝিরঝিরে হাওয়া ঢোকে ঘরের ভেতর। তাদের অন্তরে ঢোকে জোছনাফুলের ঘ্রাণ।