![ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা](uploads/2024/06/28/tripura-upakkhan-1719556701.jpg)
গত সংখ্যার পর
কী ব্যাপার এত রাতে জেগে আছ যে- খাবার খেলে না? শরীর খারাপ কি?
স্ত্রীর কথায় দত্ত বাবু বললেন, না ঠিক আছি, আচ্ছা শোন, তুমি তো সাবিনা নামের প্যাসেন্টটাকে দেখেছ? কী মনে হয় তোমার?
গাইনোকলজিষ্ট স্ত্রী বললেন- বারকয়েক দেখেছি। ভেবেছিও। ও রকম একটা ছোট্ট মেয়ের ওপর যে টরচার হয়েছে তাতে ওর বেঁচে থাকাই কঠিন। কিন্তু সে বেঁচে আছে!
কিন্তু জানিনে কীভাবে তা সম্ভব? তোমার কী মনে হয়? ওকে কি নরমাল লাইফ দেওয়া সম্ভব হবে?
ভেরি ডিফিকাল্ট। শুনলাম, জ্ঞান ফিরলে আবারও ফেইন্ট হচ্ছে। রক্তপাত বন্ধ করা যাচ্ছে না। জেনিটাল অরগানগুলো টোটালি ড্যামেজ্ড। আগে জেনারেল হেল্থটাকে ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করা যাক, পরে না হয় সার্জারির কথা ভাবতে পার। কিন্তু আগরতলায় সে রকম প্লাস্টিক সার্জন পাবে কোথায়?
সবই জানি, কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জটা নিতে চাই স্বপ্না। কী নিঃষ্পাপ ফুলের মতন ফুটফুটে মেয়ে, ঠিক আমাদের মেয়ের মতন!
স্বামীর মুখ দেখে ওর মনটাকে বোঝবার চেষ্টা করে স্ত্রী। বলে- দেখ চেষ্টা করে- আমিও থাকব তোমাদের সঙ্গে।
গভীর রাতে ডাক্তার দত্ত ও তার স্ত্রী যখন কথা বলছিলেন ঠিক তখনই বর্ডারের ওপার থেকে রাইফেল-মেশিনগানের কর্কশ আওয়াজ শোনা গেল। একই মাটি, একই আলো-বাতাস, ভাগ হয়েছে দুই দেশের সীমানায়। আগরতলায় বসে পূর্ববঙ্গের গাছে বসা পাখির গান শোনা যায়, মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, মাঠে কৃষকের গান, ট্রেন চলার শব্দ- সব কানে আসে। অতএব, আগ্নেয়াস্ত্রের লাগাতার শব্দ রাতের শহর আগরতলাকে কাঁপিয়ে তুলল। এরই মধ্যে পাশের ঘর থেকে আতঙ্কিত মেয়ে দেবলীনা দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। কামান দাগার বিকট আওয়াজ হতেই দেবলীনা মাকে ছেড়ে বাবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ডাক্তার দত্ত বললেন- ওপারে যুদ্ধ চলছে মা, আমাদের ভয়ের কিছু নেই।
কিন্তু আমার ভয় করে বাবা। ভীষণ ভয় করে। কিছুই ভালো লাগে না।
শরণার্থী সংকট ও যুদ্ধের কারণে দেবলীনাদের স্কুল বন্ধ। সারা দিন শুয়ে-বসে থাকতে হয়। আগের মতো বন্ধুরা কেউ আসে না, সেও যেতে পারে না কোথাও। এভাবে সময় কাটাতে তার একদম ভালো লাগে না।
সে রাতেই আগরতলা এয়ারপোর্টের কাছে কামানের গোলা পড়ল কয়েকটা। বিকট শব্দে কুঞ্জবনে রথীন দত্তের বাড়িটাই কেবল কেঁপে উঠল না গোবিন্দ বল্লভ হাসপাতালও কেঁপে উঠল। ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে ভয়ানক আতঙ্ক ছড়াল। সবাই ছোটাছুটি শুরু করল। সাবিনার মা পারভীন আক্তার নিজেও সৈন্যদের দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সপ্তাহ কয়েক চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলেও এখনো ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। কাছাকাছি কোথাও কামানের গোলা পড়ায় তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন। অনেক কষ্টে পা ফেলে মেয়ের বেডের দিকে এগিয়ে গেলেন। ভয়ে, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সাবিনা। মা কাছে যেতেই তাকে জড়িয়ে ধরে বলল- ওই যে মিলিটারি আসছে মা, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলেন পারভীন আক্তার। আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন। বললেন- ভয় পাস না মা- এটা ইন্ডিয়া, আরেক দেশ, জল্লাদেরা এদিকে আসবে না।
কিন্তু সাবিনার আর্তচিৎকার থামানো গেল না। সে কাঁপতে থাকল। নাক থেকে অক্সিজেনের নলটা টেনে খুলে ফেলল। কোমরের নিচের নলগুলো খোলার চেষ্টা করল। পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে পারভীন আক্তার চিৎকার করে নার্স ডাকলেন। সঙ্গে সঙ্গেই দুজন নার্স দৌড়ে এল। এসেই একজন শক্তি দিয়ে সাবিনাকে চেপে ধরল, অন্যজন নাকমুখের নলগুলো লাগিয়ে দিতে দিতে বলল- এ রকম করলে কী চলে! লক্ষ্মী মেয়ে, প্লিজ, তুমি চুপ করে থাক। এখানে কোনো ভয় নেই তোমার। আমরা আছি তো।
৫.
৫ আগস্ট ১৯৬৫ সাল। নতুন উত্তেজনা শুরু হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান আকস্মিকভাবে তার ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ শুরু করলেন। হাজার হাজার পাকিস্তানি সেনা রাতারাতি ঢুকে পড়ল জম্মু ও কাশ্মীরে। ভারতের হাত থেকে কাশ্মীর মুক্ত করতে হবে। শান্তিপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী বিপাকে পড়লেন। হুকুম দিলেন ভারতের সেনাবাহিনীকে পাল্টা আক্রমণের। ৫ আগস্ট থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর- চলল সাত সপ্তাহের ভয়ংকর যুদ্ধ। মারা গেল দুই দেশের হাজারো সেনা। ধ্বংস হলো ঘরবাড়ি, স্থাপনা।
সে যুদ্ধে ভারত পূর্ব ফ্রন্টে যুদ্ধ চালায়নি। যদি আক্রমণ হতো তাহলে কী ছিল পূর্ব অংশের প্রতিরক্ষা দেওয়ার? কিছুই নেই! আত্মরক্ষার যা কিছু সবই পশ্চিম পাকিস্তানে! অতএব, শক্ত অবস্থান নিলেন শেখ মুজিবুর রহমান: কেবল অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু নয়, সামরিক দিক দিয়েও অরক্ষিত রাখা হয়েছে বাংলাকে। এর থেকে পরিত্রাণ দরকার।
৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সাল। পূর্ব বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে শেখ মুজিবুর রহমান তার ছয় দফা দাবি পেশ করলেন। প্রথমত লাহোরে- পরে ঢাকায় ফিরে বিস্তারিতভাবে। পূর্ব বাংলাসহ প্রদেশগুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। প্যারামিলিটারি রাখার অধিকার দিতে হবে। বিদেশ বাণিজ্যের অধিকার থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পূর্ব পাকিস্তানের জন্যই ব্যয় হবে। অতএব, মোড় ঘুরে গেল পাকিস্তানি রাজনীতির। ছয় দফার স্লোগানে কাঁপতে থাকল পূর্ব পাকিস্তান, জেগে উঠতে থাকল বাঙালি। বিপরীতে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল সামরিক জান্তার। দিন যত যেতে লাগল, ধর্মের বর্ম-পরা গণবিরোধী শাসকচক্রের চোখে পাকিস্তানি অখণ্ডতার পয়লা নম্বরের দুশমন হয়ে উঠলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। শুরু হলো লাগাতার নিপীড়ন, জেলজুলুম। প্রথমত, হেনস্থার কূটকৌশল আঁটা হলো; দ্বিতীয়ত, চলল স্বাধিকারের আন্দোলনকে স্তব্ধ করার সর্বগ্রাসী ষড়যন্ত্র।
শেখ মুজিবুর রহমান এবং কিছু বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা কি সত্যি সত্যি ভারতের সাহায্য নিয়ে হাজার মাইল দূরের উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি দাসত্ব হঠাতে চেয়েছিলেন? চাইলেও চাইতে পারেন, আপত্তির কিছু ছিল না। কিন্তু এ নিয়ে কোনো বিবৃতি দেননি শেখ মুজিব, গ্রহণযোগ্য কোনো গবেষণাও হয়নি। তবে আগরতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের একবারের আগমন নিয়ে রাজ্যের সেদিনকার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের একটি স্মৃতিচারণ আছে।
চলবে...