![আহমদ ছফা: উত্তর প্রজন্মের সাহস](uploads/2024/06/28/ahmad-sofa-1719554944.jpg)
আহমদ ছফা জীবনের প্রতিটি বাঁকে ঠেকে শিখেছেন। সময় কখনো তার প্রতি সদয় হয়নি। প্রতি পদে তিনি মুখোমুখি হয়েছেন কঠিন বাস্তবতার। দেখেছেন টিকে থাকার লড়াই কত উলঙ্গ আর মর্মঘাতী। হতে পারে সেই কঠিন সময় তাকে স্পষ্টভাষী আর প্রতিবাদী বানিয়েছে। সত্য কথায় কোনো আড়াল-আবডাল না রেখে স্পষ্ট উচ্চারণে তিনি হয়ে উঠেছেন গণমানুষের মুখপাত্র। সাধারণ মানুষ যা মনে ধারণ করে, উচ্চারণে ভীতি জাগে, তিনি সেই কথা বলেছেন অকপটে।...
আপস করতে করতে আমাদের শিরদাঁড়া বাঁকা হয়ে গেছে। মরা ইলিশের অস্বচ্ছ চোখের মতো উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে আমরা চারপাশ দেখি। ঋজু হয়ে দাঁড়ানোর জন্য যে সাহস দরকার, যাকে দেখে আমরা আত্মবিশ্বাসী হব, আমাদের সামনে অনুসরণীয় সেই সাহসী ব্যক্তিত্ব দেখি না। আমরা নুয়ে পড়তে পড়তে নতজানু হয়ে পড়ি। কিন্তু আছেন। সেই অসমসাহসী উচ্চারণের আপসহীন মুক্তবুদ্ধিচর্চার মানুষ আমাদের সামনে আছেন। তিনি আহমদ ছফা।
একরোখা, ঠোঁটকাটা, নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণে দ্বিধাহীন মানুষ তিনি। তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী। সৃষ্টিশীল লেখক। জন্মেছেন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে। ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন। তখন অস্থিরকাল। বাংলাজুড়ে হাহাকার। ব্রিটিশ শাসক যুদ্ধরত সৈনিকদের জন্য বিপুল পরিমাণ খাবার মজুদ করায় দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ। কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান আহমদ ছফাকে জন্ম থেকে দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রুটিরুজির জন্য লড়াই করে গেছেন। লিখে উপার্জনের অতিরিক্ত তার আর কোনো আয়ের সংস্থান ছিল না। আহমদ ছফা জীবনের প্রতিটি বাঁকে ঠেকে শিখেছেন। সময় কখনো তার প্রতি সদয় হয়নি। প্রতি পদে তিনি মুখোমুখি হয়েছেন কঠিন বাস্তবতার। দেখেছেন টিকে থাকার লড়াই কত উলঙ্গ আর মর্মঘাতী। হতে পারে সেই কঠিন সময় তাকে স্পষ্টভাষী আর প্রতিবাদী বানিয়েছে। সত্য কথায় কোনো আড়াল-আবডাল না রেখে স্পষ্ট উচ্চারণে তিনি হয়ে উঠেছেন গণমানুষের মুখপাত্র। সাধারণ মানুষ যা মনে ধারণ করে, উচ্চারণে ভীতি জাগে, তিনি সেই কথা বলেছেন অকপটে।
বাংলাদেশের অন্যতম সেরা লেখকদের একজন আহমদ ছফা। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। সব্যসাচী বিরলপ্রজ্ঞা এই লেখক গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি, অনুবাদ, শিশু-কিশোরসাহিত্য- সব ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন অবাধে। বেশ কিছু গানও রচনা করেছেন। আহমদ ছফা সম্পর্কে এক প্রসঙ্গে সরদার ফজলুল করিম বলেছেন, ‘ছফা কেবল পাঠ করার বিষয় নয়, চর্চা করার বিষয়।’
লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা অনেকে উৎসাহিত হয়েছেন আহমদ ছফার বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শন থেকে। তার প্রথাবিরোধী স্পষ্টবাদিতা উৎসাহিত করেছে অনেককে নিজ সৃষ্টিকর্মে। তাকে কেউ বলেছেন বিদ্রোহী, কেউ বলেছেন উদ্ধত, আবার কেউ বোহেমিয়ান। তবে তিনি ছন্নছাড়া ছিলেন না মোটেও, হতে পারে খানিক খেয়ালি মানুষ ছিলেন। বাংলাসাহিত্যের তুমুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জীবনে আহমদ ছফা প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তার লেখা ‘বলপয়েন্ট’ বইতে আহমদ ছফাকে নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। যে-লেখা থেকে খানিকটা হলেও ব্যক্তি আহমদ ছফাকে চিত্রায়িত করা যায়। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘আমি আমার যৌবনে হন্টন পীরের মতো একজনকে পেয়েছিলাম। আমরা দলবেঁধে তার পেছনে হাঁটতাম। তিনি যদি কিছু বলতেন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। গভীর রাতে নীলক্ষেত এলাকায় তিনি হাঁটতে হাঁটতে আবেগে অধীর হয়ে দুই হাত তুলে চিৎকার করতেন। ‘আমার বাংলাদেশ! আমার বাংলাদেশ!’ আমরা গম্ভীর মুগ্ধতায় তার আবেগ এবং উচ্ছ্বাস দেখতাম। তার নাম আহমদ ছফা। আমাদের ছফা ভাই।’
বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান আহমদ ছফা। স্কুলে পড়েছেন চট্টগ্রামে আর কলেজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে তিনি এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে। ছাত্রাবস্থা থেকেই আহমদ ছফা আগ্রহী ছিলেন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস অনুসন্ধানে। সেই আগ্রহ থেকে রচনা করেন সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস। তবে তার প্রথম প্রকাশিত বই সূর্য তুমি সাথী, একটি উপন্যাস। তার লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের ভেতর আছে- সূর্য তুমি সাথী, উদ্ধার, একজন আলী কেনানের উত্থান পতন, অলাতচক্র, ওঙ্কার, গাভীবৃত্তান্ত, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী, পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ। এসব উপন্যাসে উঠে এসেছে বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, লড়াই করে বেঁচে থাকার সাহস, স্বাধীনতার জন্য স্পৃহা, মুক্তির উন্মাদনা আর সামাজিক অসঙ্গতি এবং অসহনীয় বৈষম্যের কথা। নিহত নক্ষত্র তার লেখা গল্পগ্রন্থ। সমাজ গঠন, বিকাশ, উত্থান, প্রতিষ্ঠা আর বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা নিয়ে আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেছেন প্রতিনিয়ত। তার লেখা দুটি উল্লেখযোগ্য রচনা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস আর বাঙালি মুসলমানের মন।
আহমদ ছফা বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তবুও তিনি এই সংগঠনের দেওয়া পুরস্কার গ্রহণ করেননি। প্রত্যাখ্যান করেছেন বাংলা একাডেমির সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই মানুষ পুরস্কার নয়, বরাবর বিশ্বাস রেখেছেন নিজ চিন্তা ও কাজে। আহমদ ছফা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য শিল্পী সুলতান পাঠশালা বানিয়েছিলেন। অন্যান্য কাজের ভেতর সেটি তার মহান কীর্তি।
তুখোড় বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করলেও আহমদ ছফা নিজেকে কখনো বুদ্ধিজীবী তকমায় আটকে ফেলেননি। বরং তিনি নতজানু, সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা করেছেন তীব্রভাবে। বুদ্ধিজীবীদের সময়োচিত সিদ্ধান্তগ্রহণে ব্যর্থতার করা বলেছেন অতি দৃঢ় ও খোলা গলায়, নগ্নভাবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই (১৯৭২) প্রকাশিত আহমদ ছফার লেখা বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস প্রবন্ধগ্রন্থের ‘লেখকের কথা’ অংশ শুরু করেছেন এভাবে- ‘আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যখন রক্ত দিয়েই চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি। চারদিকে এত অন্যায়, অবিচার এত মূঢ়তা এবং কাপুরুষতা ওঁৎ পেতে আছে যে এ ধরনের পরিবেশে নিতান্ত সহজে বোঝা যায় এমন সহজ কথাও চেঁচিয়ে না বললে কেউ কানে তোলে না।’ যা এখনো প্রাসঙ্গিক।
তিনি প্রবন্ধের শুরুতে লিখেছেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।
আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়- প্রয়োজনে, এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন- তাও ঠেলায় পড়ে।’
এমন সহজভাবে নিঃসংকোচে নিরেট-নিখাঁদ সাহসী উচ্চারণ বেশি কাউকে করতে দেখা যায়নি। আহমদ ছফা উত্তর প্রজন্মের জন্য সাহস রেখে গেছেন। লিখে গেছেন সেই সব কথা, যা আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি এনে দেবে। সেই সাহসে ভর করে আহমদ ছফা চর্চার মাধ্যমে উত্তর প্রজন্ম আনবে মুক্তি।
জন্মদিনে আহমদ ছফার প্রতি আভূমিনত শ্রদ্ধা আর নিতল ভালোবাসা।