একটি কবিতা শুধু একবারই হয়, পরের বার একই রকম আর কখনোই হয় না। আমার বিশ্বাস, সেটা একই রকমের ভালো হবে। এত নিশ্চিত তুমি হলে কী করে? কোনো কবিতার সার্থকতা তো ওই একবারই আসে। আর তা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর, তোমার ওপর নয়। আমার ধারণা, পরিস্থিতিটাও অবিকল একই থাকবে। তা-ই যদি মনে হয়, তাহলে তো তুমি কবি ছিলেও না, কবি হবেও না। তারপরও কেন ভাবছ, তুমি একজন কবি? মানে, আমি ঠিক জানি না।…
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ১৯৬৫ সালের মার্চের ৪ তারিখ রংপুরের নীলফামারীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে কবি, লেখক, নাট্যকার ও সাংবাদিক। আনিসুল হক প্রকৌশলী হিসেবে লেখাপড়া শেষ করলেও সাংবাদিকতা দিয়েই শুরু করেছিলেন তার কর্মজীবন। কবিতা, গল্প, কলাম, উপন্যাস ও সিনেমার চিত্রনাট্যসহ সব শাখাতেই তার অবাধ বিচরণ। বর্তমানে তিনি দৈনিক ‘প্রথম আলো’র সহযোগী সম্পাদক পদে কর্মরত আছেন। কিন্তু তার মূল ঝোঁক লেখালেখিতে। বুয়েটে পড়ার সময় কবিতার দিকে বেশি মনোনিবেশ করেন। পরবর্তীতে এর পাশাপাশি কথাসাহিত্যেও মনোযোগী হন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সত্য ঘটনা নিয়ে তার লেখা ‘মা’ বইটি বেশ জনপ্রিয়। এ রকম তার বেশ কয়েকটি উপন্যাস পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ১০০। পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কলাম লেখেন। শ্রেষ্ঠ টিভি নাট্যকার হিসেবে পুরস্কার, টেনাশিনাস পদকসহ বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০১২ সালে কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।
আপনি এখন কী লিখছেন?
অরুন্ধতী রায় আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমি যখন লিখি না, তখনো লিখি। এই কথাটা সত্য। আবার মিরোস্লাভ হোলুবের কবিতা আছে, সাজ্জাদ শরিফের অনুবাদে সেটা তুলে ধরি- কবির সঙ্গে আলাপচারিতা মিরোস্লাভ হোলুব অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ তুমি কি কবি? হ্যাঁ, আমি কবি। কী করে বুঝলে? কবিতা লিখেছি যে। যদি লিখে থাক, তাহলে কবি ছিলে। কিন্তু এখন? আবার একদিন কবিতা লিখব। সে দিন হয়তো আবার কবি হবে। কিন্তু কী করে বুঝবে সেটা কবিতাই হয়েছে? সেটাও আগেরটার মতো কবিতা হবে। তাহলে তো সেটা কবিতাই হবে না।
কিন্তু বলো তো, তুমি কে? তো আমি যখন লিখি না, তখন কিন্তু আমার মনে হয়, আমি আর পারব না। আগের বার যা লিখেছিলাম, তা-ই যদি আবার লিখি তাহলে তো আর আমি লেখক থাকব না। সব সময় নতুন কিছু, ভিন্ন কিছু না লিখতে পারলে মানুষ আর লেখক থাকে না। সে মেশিন হয়ে যায়। প্রতিটা লেখা শেষ করার পর আমার লেখক-সত্তা মরে যায়। আমার ভয় হয়, আমি পারব না। যখন নতুন আরেকটা লেখা শুরু করি, খুব অসহায় লাগে। তারপর সেটা যখন শেষ করি, কী যে আনন্দ হয়! পারলাম তো! তো এখন আমি কী লিখছি? প্রতি সপ্তাহে একটা করে কলাম লিখতেই হয়, প্রথম আলোর জন্য। প্রতি মাসে একটা করে কিশোর-রচনা লিখতেই হয়, কিশোর আলোর জন্য। ঈদসংখ্যায় একটা উপন্যাসের প্রথম খসড়া বেরিয়েছে- ‘আপনি কি কখনো ভূত দেখেছেন’। এই খসড়াটা কাটাছেঁড়া চলছে। পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস হিসেবে এটাকে লিখতে হবে। আরেকটা কাজ করলাম। ‘কখনো আমার মাকে’ উপন্যাসটা পুনর্লিখন করলাম। এর কলেবর এখন দেড় গুণ বাড়বে।
আপনি এখন কী পড়ছেন?
আমি একসঙ্গে অনেক কিছু পড়ি। ভিনসেন্ট চ্যাংয়ের বই প্রথমা বের করেছে- ‘ভিনসেন্ট অব বাংলাদেশ’। সেটা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ভিনসেন্ট চ্যাং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। খুবই আকর্ষণীয় তার জীবনকাহিনি। কাল রাতে পড়ছিলাম মিলান কুন্ডেরার লেখা ‘টেস্টামেন্ট বিট্রেয়েড’। উপন্যাসের করণকৌশল নিয়ে লেখা আলোচনার বই। কুন্ডেরা এখানে পৃথিবীর সেরা উপন্যাসগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলছেন, পৃথিবীতে আগে হিউমার ছিল না। কৌতুক ছিল, বিদ্রূপ ছিল, কিন্তু হিউমার ছিল না। হিউমার আবিষ্কার করেন সারভেন্তেস। ‘ডন কুইক্সোট’ উপন্যাসে। এই বইয়েই তিনি নিচের ব্যাপারটা নিয়ে লিখেছেন: মিলান কুন্ডেরার একটা উপন্যাস আছে ‘ফেয়ারওয়েল পার্টি’। ওই উপন্যাসে মিলান কুন্ডেরা এক চিকিৎসকের চরিত্র সৃষ্টি করেন। তার নাম ডাক্তার স্ক্রেটা। যেসব নারীর সন্তান হয় না, ডাক্তার স্ক্রেটা তাদের চিকিৎসা করেন। তিনি নিজের স্পার্ম ওই নারীদের ইনজেক্ট করে দেন। তাদের অনেকেই সন্তান লাভ করে। উপন্যাসের একটা জায়গায় বর্ণনা আছে, ডাক্তার স্ক্রেটা পথ দিয়ে যাচ্ছেন, বাচ্চারা মাঠে খেলছে, তিনি তাকিয়ে দেখছেন, কয়টা বাচ্চা দেখতে তার মতো হয়েছে।
মিলান কুন্ডেরা বলেন, তিনি এই চরিত্র ও ঘটনা লিখেছেন একেবারেই হালকা চালে। কৌতুক করার জন্য। কিন্তু ব্যাপারটা কৌতুক রইল না। একদিন মেডিসিনের এক অধ্যাপক তার কাছে এসে হাজির। অধ্যাপক বললেন, ‘‘আমি আপনার লেখার খুব সিরিয়াস পাঠক। আপনার প্রতিটা লাইন আমার মুখস্থ। আমি একটা সেমিনারের আয়োজন করছি। এটার বিষয় হলো ‘বন্ধ্যত্ব ও স্পার্ম ডোনেশন’। আপনার উপন্যাস ‘ফেয়ারওয়েল পার্টি’তে ব্যাপারটা আছে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এভাবে একটা কঠিন সমস্যার সমাধান হতে পারে। আপনি অবশ্যই আমার সেমিনারে আসবেন। আপনি বক্তব্য দেবেন।’’ কুন্ডেরা বললেন, ‘আমার উপন্যাসকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। আমি এটা নিতান্তই কৌতুক করার জন্য লিখেছি।’ অধ্যাপক পরম বিস্ময়ে কুন্ডেরার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার উপন্যাসকে আমরা গুরুত্ব দেব না? আপনি নিজে লেখক হয়ে এ কথা বলতে পারলেন? আপনার লেখাকে আমরা গুরুত্ব দেব না?’ কুন্ডেরা বললেন, ‘ভাই, লেখকদের সব কথায় গুরুত্ব দেবেন না।’ এই যে ডাক্তার, তিনি কিন্তু হিউমার বোঝেন না।
তার আগের রাতে আমি পড়ছিলাম ‘টুমরো টুমরো টুমরো।’ গাব্রিয়েল জেভিনের লেখা। নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার। আমার মেয়ে বইটা আমাকে পড়তে বলেছে, তাই পড়ছি। তার আগে সানিয়া রুশদীর ‘হসপিটাল’ পড়ে শেষ করেছি। এটা কিন্তু আগে বাংলায় বেরিয়েছিল। ব্রাত্য রাইসু বের করেছিলেন। পড়ে অরুণাভ সিনহা অনুবাদ করেন ইংরেজিতে। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি লেখকের বইটা নানা পুরস্কারে শর্ট লিস্টে নাম লেখাচ্ছে।
জ্যাক কেরুয়াকের কবিতা অনুবাদ করলাম একটা। রুমির কবিতা পড়ি। আর সব সময় পড়ি রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ কবিতা আবার পড়লাম। প্রশ্ন কবিতাটা আবার পড়লাম। প্রশ্ন সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের একমাত্র কবিতা যেখানে তিনি প্রেম ও ক্ষমার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলছেন, ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো। বায়ুদূষণ আলোদূষণের পাপের কিন্তু ক্ষমা নেই।
খবরের কাগজ সাহিত্যপাতা ‘সুবর্ণরেখা’ সমৃদ্ধ হোক- এই কামনাই রইল।
সাক্ষাৎকার: সানজিদ সকাল