রাজনীতিবিদ, সাংসদ এবং প্রাক্তন মন্ত্রী হায়াকাওয়া তাকাশি জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক কিংবদন্তিতুল্য নাম। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে হায়াকাওয়া তাকাশির ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ঐতিহাসিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি ব্যাপক ভূমিকা রেখে গেছেন। তারই সূত্র ধরে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নানামুখী দ্বারও উন্মোচিত হয়েছে। সেসব দুয়ার দিয়ে বিনিয়োগ, কল-কারখানা স্থাপন, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণসহ বহুবিধ খাতে বিশ্বস্ত পার্টনারশিপ অব্যাহত রেখে আসছে বাংলাদেশে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান শক্তিশালী দেশ জাপান।
এসব বিষয়েই বিস্তারিত তথ্য ও ইতিহাস ঘেঁটে জানান দিচ্ছেন চার দশকের মতো জাপান প্রবাসী কথাসাহিত্যিক ও গবেষক প্রবীর বিকাশ সরকার তার ‘বঙ্গবন্ধু এবং জাপান সম্পর্ক’ নামক সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গ্রন্থে। ইতোমধ্যে প্রকাশিত তার প্রায় ৩০টি গ্রন্থের বেশির ভাগই জাপান-বাংলাদেশ-ভারতের আন্তসম্পর্ক নিয়ে রচিত। হিন্দি ভাষায় অনূদিত হয়েছে একটি বই দিল্লি থেকে ২০০৮ সালে। জাপানি ভাষায় প্রকাশিত লেখকের একটি বই আমাজন অনলাইনে বেস্ট সেলার হয়েছে ২০২১ সালে।
নানা ধরনের পুরনো ও নতুন ইতিহাসসমৃদ্ধ পৃথক পৃথক কয়েকটি প্রবন্ধ রয়েছে এতে। সেই সঙ্গে আছে রচনাশৈলীর মাঝে এক ধরনের তীব্র ঝাঁঝও। জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যে অনেক অতীত থেকে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ- তা জেনেও আগ্রহী পাঠকবৃন্দ তৃপ্ত হতে পারবেন নিঃসন্দেহে এ বইয়ের মাধ্যমে।
উল্লেখ্য, এশিয়ার এ দুটি অঞ্চলের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের শুরু সেই ১৯০২ সাল থেকে। জাপানি মনীষী ওকাকুরা তেনশিন তখন ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতায় যান। বইটিতে জানা গেল, ১৯০৮ সালে জাপানি বৌদ্ধভিক্ষু কিমুরা রিউকান পালি ভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে আসেন। আরও চমকপ্রদ তথ্য, পুরনো ঢাকার মেয়ে হরিপ্রভা মল্লিকের সঙ্গে বিয়ে হয় জাপানি নাগরিক তাকেদা উয়েমোনের। তারপর তারা একসঙ্গে জাপানে যান ১৯১২ সালের দিকে।
বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপান যান ১৯১৫, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬, সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৩ এবং বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল জাপান গমন করেন ১৯৪৬ সালে টোকিও ট্রাইব্যুনালে আসন গ্রহণের উদ্দেশ্যে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপান যান ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে।
জাপান-বাংলা সম্পর্ক মানেই এক দুর্দান্ত ইতিহাস, জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের পটভূমি, আরও পুরনো সংযোগ, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রভাব, টোকিও ট্রাইব্যুনাল বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল ও তানাকা মাসাআকি, দুটি দলিল এবং বঙ্গবন্ধু শীর্ষক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধের সমাহার রয়েছে এ বইয়ে। সেই সঙ্গে পরিশিষ্টে সংযুক্ত আছে ১৫ আগস্ট জাপান ও বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখা ও ‘মানচিত্র’ পত্রিকা ইত্যাদি।
এই লেখকের ভাষ্যে জানা যাচ্ছে, ‘বহু জাপানি আজও মনে করেন জেনারেল তোজো হিদেকিই আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধানোর জন্য দায়ী। তারা যে আসলে অজ্ঞ এবং ইতিহাসকানা- তা আর না বললেও চলে। মার্কিনি, ব্রিটিশ এবং রাশিয়ানদের গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে জাপান, তা আজ দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত করেছে ইহুদি বিশ্ব পুঁজিপতিরা বিশ্বকে তাদের হাতের মুঠোয় রেখে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য’।
এরকম তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণমূলক পর্যালোচনা রয়েছে এ বইয়ের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠাজুড়ে। উল্লেখ্য, ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকিকে যুদ্ধাপরাধী বলে মনে করা হয়ে থাকে। জাপানিদের উল্লেখযোগ্য অংশও তেমনটি মনে করেন এখনো।
আর সেই তোজো হিদেকি সম্পর্কে আলোচ্য গ্রন্থকার বলছেন, ‘তার মতো বুদ্ধিমান, সু-সংবেদনশীল এবং দরদি দেশপ্রেমিক জাপানে আজও বিরল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় চারটি বছর তিনি যেভাবে মিত্রশক্তিকে নাকানি-চোবানি খাইয়ে জাপান ও এশিয়া মহাদেশকে রক্ষা করেছিলেন তার তুলনা নেই বললেই চলে।’... ‘বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও ছিলেন অত্যন্ত উদার মনোভাবাপন্ন কিন্তু খাঁটি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রনায়ক। দুজনেই বেঁচে থাকলে সমগ্র এশিয়া এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বহু আগেই অর্জিত হতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ (পৃষ্ঠা-৯৬; বঙ্গবন্ধু এবং জাপান সম্পর্ক)।
প্রবন্ধগুলোর শেষে জাপানি ভাষায় প্রকাশিত কিছু তথ্যসূত্র রয়েছে। যেমন, পারু হানকেৎসু শো নো শিনজিৎসু / ওয়াতানাবে শোওইচি / পৃ. ৮৮। প্রয়োজনীয় এ সূত্রগুলো ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় হলে খুঁজে দেখার সুবিধে হতো। পরিশিষ্টে অনেকগুলো ছবি আছে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের। ছবিগুলোর গুরুত্ব ঐতিহাসিক। বইয়ের ভেতর ও ছবি পরিচিতিতে আরও সম্পাদনা এবং মুদ্রণ তদারকিতে সতর্কতার অবকাশ লক্ষণীয়।
এসব মিলিয়ে পরিচ্ছন্ন, আকর্ষণীয়, ঝকঝকে ছাপা, গুণগত মান ও দৃষ্টিনন্দন অঙ্গসৌষ্ঠবসহ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে এনআরবি স্কলার্স পাবলিশার্স লিমিটেড। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি নিউইয়র্ক-লন্ডন-টরেন্টো-সিডনি-ঢাকা ভিত্তিক। তবে দেশের পাঠকরা সাধারণত যে সাইজের বই হাতে নেড়েচেড়ে ও পড়তে অভ্যস্ত্য এটাতে তার ব্যতিক্রম রয়েছে। বইটা বের হয়েছে অ্যালবাম সাইজে।